/  Blogs   /   কেন পাঠকমূল্যে (MRP) বই?
g

কেন পাঠকমূল্যে (MRP) বই?

বাংলাদেশে আর কোনো পণ্যে সর্বজনীনভাবে ক্রেতা-পর্যায়ে কমিশন দেয়ার রেওয়াজ নেই। শুধুমাত্র বইয়েই এই ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। হয়তো গোঁড়ায় কমিশন ব্যবস্থার উদ্দেশ্য ছিল পাঠককে বিশেষ সুবিধা দেয়া। যারা এই ব্যবস্থার প্রবক্তা তাদের চিন্তায় অসততা ছিল না, এটাও সহজেই অনুমেয়। কিন্তু বর্তমান ব্যবস্থা বাজার অর্থনীতির সাথে সামঞ্জ্যস্যপূর্ণ নয়। তাছাড়া এই কমিশন ব্যবস্থা পাঠককে কোনো প্রকার সুবিধা দেয় না। শুধু পাঠক কেন, বই-বিক্রেতা অথবা প্রকাশক কাউকেই কোনো সুবিধা দেয় না। পাঠককে রীতিবদ্ধ ২০-২৫% ছাড় দেয়া হয়, তা বই উৎপাদন-মূল্যের সাথে আগে থেকেই যুক্ত করে একটা বাড়তি মূল্য নির্ধারণ করা হয়। এটা প্রকাশক যেমন জানেন, তেমনি জানেন বই-বিক্রেতা এবং পাঠক। সুতরাং, ব্যবস্থাটির শূন্যগর্ভ অবস্থা সবারই জানা। এটিকে ফুলে-ফেঁপে ওঠা জ্বালদেয়া দুধের সঙ্গে চিহ্নিত করা যায়। মানুষ-মাত্রই জানে ওই ফুলে-ফেঁপে ওঠা তপ্তদুধটুকু সঠিক পরিমাণ নির্দেশ করে না।

বইয়ের ক্রেতা কে?

বাংলাদেশে বইয়ের ক্রেতা অত্যন্ত অপ্রতুল। তা এতই নগণ্য যে জনসংখ্যার তুলনায় শতাংশে হিসেব করাই মুশকিল। অথচ পৃথিবীর ছোট জনসংখ্যার অনেক দেশেই পাঠক-ক্রেতার সংখ্যা আমাদের চেয়ে ঢের বেশি। আমাদের এই ক্ষুদ্র পাঠক-গোষ্ঠীর সিংহভাগই মধ্যবিত্ত ঘরনার। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক আবার ছাত্র। উচ্চবিত্ত বা নিম্নবিত্ত অত্যন্ত নগন্য। মধ্যবিত্তের আজন্ম টানাপোড়েনের মধ্যেই তারা বই কেনেন। প্রকাশনা শিল্পের আশার বিষয়--মধ্যবিত্তের সংখ্যা ক্রমশই বাড়ছে। ফলস্বরূপ নিয়ত সম্প্রসারিত হচ্ছে বইয়ের খুচরা বাজার।

মুদ্রিত মূল্যে বই, কার লাভ কার ক্ষতি?

বিদ্যমান ব্যবস্থায় বইক্রেতার অধিকাংশেরই বাড়তি ছাড় পাওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা যায়। এটা দোষের নয়, কিন্তু চলমান ব্যবস্থার দুর্বলতাই পাঠককে এই অস্থিরতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। অপরদিকে এই দুর্বলতায় অধিকাংশ প্রকাশক ও বই-বিক্রেতারা কোনো সুনির্দিষ্ট পেশাদারি নীতিনিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণে ব্যর্থ হচ্ছেন। ফলশ্রুতিতে বই-বাজারে চলছে চরম অস্থিরতা। এই অস্থিরতা কোভিড পরবর্তী সময়ে যেন নৈরাজ্যে রূপ নিয়েছে। এতে পাঠক হয়তো কিছুটা বাড়তি ছাড়ে আপাত বই কিনতে পারছেন, কিন্তু বই-বিক্রেতা বা প্রকাশক আগামীতে বইয়ের মূল্য নির্ধারণে আরো কৌশলী হবেন। তার প্রভাব পড়বে ক্রেতার উপর। এভাবে একটি দুষ্টচক্রের ঘূর্ণিবর্তে বারবার আবর্তিত হতে থাকব আমরা। কোনো টেকসই বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ব্যর্থ হব। আদতে দুর্বল হবে আমাদের বই-বাজার, প্রকাশনা শিল্প। সুতরাং, এখনই সময় এই অস্থিরতার লাগাম টেনে ধরার। মুদ্রিত মূল্যে (MRP) বই বিক্রি হতে পারে এই উদ্যোগের শুরু।

 বইয়ের দোকানগুলোকে (বুকশপ) কে বাঁচাবে?

একটি ধর্মকথা আছে--যে নিজেকে সাহায্য করে না, খোদাও তাকে সাহায্য করেন না। এই আপ্তবাক্যটি আমাদের দেশের বই বিক্রেতাদের জন্য প্রযোজ্য। একের পর এক বন্ধ হচ্ছে বইয়ের দোকান অথবা রূপান্তরিত হচ্ছে ‘সৃজনশীল গাইড বইয়ের দোকানে’। প্রকাশনা শিল্পকে বাঁচাতে হলে রক্ষা করতে হবে এগুলোকে। কিন্তু যে নিজেই বাঁচতে চায় না, তাকে বাঁচাবে কোন অলৌকিকতা! দেশব্যাপী বই-বিক্রেতাদের অপেশাদারি মনোভাব বিষিয়ে তুলছে পেশাদারি প্রকাশকদের; একই সঙ্গে নিশ্চিত করছে নিজেদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তাকে। ফলে পাঠক তার কাঙ্ক্ষিত বইটি নিকটস্থ বইয়ের দোকানে পান না। তাকে নির্ভর করতে হয় নামী-বেনামী অনলাইন বুকশপের উপর। ফলে বিস্তৃত ও বিকশিত হচ্ছে অনলাইন বই-বাজার। অবশ্য এর উল্টো চিত্রও আছে, দেশজুড়ে গড়ে উঠেছে কয়েকটি চেইন বুকশপ। যদিও তা যথেষ্ট নয়। তবুও আশা দেখাচ্ছে পাঠক-প্রকাশকদের।

প্রকাশক কেন বই-বিক্রেতা?

প্রকাশক এবং বই-বিক্রেতার মাঝে বিস্তর ফারাক। এই পার্থক্যের মূলে রয়েছে মুনাফা আর সৃজনশীলতা। প্রকাশক কোনটিকে বেছে নেবেন? আর কোনটিকে নেবেন বই-বিক্রেতা? যদি প্রকাশক সরাসরি বই বিক্রির নামে মুনাফাকেই মুখ্য করেন, তবে প্রকাশনা শিল্প হয়ে পড়বে স্থবির, বন্ধ্যা। আর বই-বিক্রেতার নিত্য-নতুন, কৌতূহলোদ্দীপক, গবেষণাধর্মী, এক্সপেরিমেন্টাল সাহিত্য অন্বেষার সুযোগই-বা কই! কাজেই যার যা কাজ, তাকে তাই করতে দিতে হবে। এজন্য প্রকাশকদের প্রয়োজনেই বাঁচাতে হবে বুকশপগুলোকে। এ-কথা ভুলে গেলে চলবে না, বইয়ের খুচরা বাজার যথেষ্ট বড় নয়। যেহেতু ভোক্তা কম, তাই বই-বিক্রেতার প্রয়োজনীয় মুনাফা অর্জন নিশ্চিত করার মাধ্যমে তাদের টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে গড়ে তুলতে হবে পেশাদারি পরিবেশক সংস্থা।

কেন পাঠক পাঠকমূল্যে বই কিনবে?

এখন প্রশ্ন পাঠক মুদ্রিত-মূল্যকে (MRP) কিভাবে গ্রহণ করবেন। পাঠকের চাই পাঠযোগ্য বই। বিক্রেতার আর প্রকাশকের চাই মুনাফা। বই ব্যবসায় মুনাফাই একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। এর রয়েছে সামাজিক দায়বদ্ধতাও। রয়েছে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ ও প্রজন্ম তৈরিতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা। মানুষের উপর রয়েছে এর প্রত্যক্ষ প্রভাব। সে দায়বদ্ধতাকে এড়িয়ে অন্য ব্যবসা করা গেলেও প্রকাশনা ব্যবসা নয়।

ধরা যাক একটি বইয়ের বর্তমান বাজার মূল্য ৫০০ টাকা। বিদ্যমান ব্যবস্থায় সাধারণত ২০% ছাড় ক্রেতা পান। অর্থাৎ, বইটির মূল দাম ৪০০ টাকা। মুদ্রিত মূল্যের ক্ষেত্রে বইটির মুদ্রিত মূল্য (MRP) হতে পারে ৪০০ টাকা। এতে পাঠকের বই ক্রয়ের ক্ষেত্রে তেমন কোন প্রভাব পড়বে না। কিন্তু গোটা ব্যবস্থায় এক ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।

তবুও কেন কমিশন ব্যবস্থা?

এক কথায় এর উত্তর দেয়া কঠিন। বইয়ে পাঠকের জন্য কমিশন ব্যবস্থা আজ বই-সংস্কৃতির অংশ। এই সংস্কৃতি বেশ পুরনো। তাই পাঠক-মনোজগতে এর গভীর ভিত্তিমূল রয়েছে। চাইলেই একে উপড়ে ফেলা যায় না। এর জন্য প্রয়োজন পাঠক-বইবিক্রেতা-প্রকাশক সকলের সচেতনতা ও সদিচ্ছা। তারও আগে দরকার এ সম্পর্কে পাঠক-বইবিক্রেতা-প্রকাশক মনে বিষয়টির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্নের উদ্রেক। তবে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে এর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারলে গোটা ব্যবস্থায় পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবী। আর যে-সকল প্রকাশনী সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে বই বিক্রির উপর নির্ভরতার কারণে এখনই এই সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না, তাদের উচিত সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে মুদ্রিত মূল্যে (MRP) বই কিনতে বাধ্য করা। এতে দীর্ঘমেয়াদে লাভবান হবে প্রকাশনা শিল্প। আর গোটা ব্যবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য চাই বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে যুগপোযোগী বিপণন ব্যবস্থা ও গ্রন্থনীতি।

f
Elephant Road, Dhaka 1205 +8809606033393 [email protected]
Free shipping
for orders over ৳1,999