সোমেন চন্দ : জন্মশতবার্ষিকী শ্রদ্ধাঞ্জলি
২০১৯ সালের ২৪ মে ছিল অমিত প্রতিভার সোমেন চন্দ (১৯২০-১৯৪২) এর শততম জন্মদিন। মূলত এদিন থেকেই শুরু হয়েছে প্রগতি সাহিত্যচর্চায় আত্মনিবেদিত সাহিত্যকর্মী সোমেন চন্দের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন। ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে বিভিন্ন আলোচনা সভা, পত্র-পত্রিকায় শ্রদ্ধা নিবেদন, স্মৃতিরক্ষার্থে বৃক্ষরোপণ প্রভৃতি কর্মসূচি। চলবে ১২০২০ সাল জুড়ে। ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত মাত্র পাঁচবছর সাহিত্যচর্চা করে এত বেশি সুনাম অন্য কোনো সাহিত্যিকের জীবনে ঘটেনি। অবশ্য তাঁর কাছাকাছি ছিলেন সুকান্ত ভট্টাচার্য (১৯২৬-১৯৪৭)। তবে সোমেন চন্দ সুনাম কুঁড়িয়েছেন গল্পকার হিসেবে এবং সুকান্ত ভট্টাচার্য কবি হিসেবে। দুজনই মার্কসবাদে বিশ্বাসী ছিলেন; আত্মনিবেদন করেছিলেন কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের জন্য। অল্প বয়সে অর্থাৎ ২১/২২ বছর বয়সে মারা গেছেন; সোমেন চন্দ ফ্যাসিবাদী আরএসপি কর্মীদের হাতে নিষ্ঠুরভাবে খুন হয়েছেন এবং সুকান্ত ভট্টাচার্য যক্ষা রোগে। সকলেই বিশ্বাস করেন এঁরা দীর্ঘায়ু লাভ করলে বাংলা সাহিত্যকে অনেক বেশি সমৃদ্ধ করতে পারতেন। সোমেন চন্দ জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৯২০ সালের ২৪ মে রাত ১০টার সময় ঢাকা জেলার আশুলিয়া গ্রামে মাতামহের বাড়িতে এবং মারা যান ঢাকাতে ১৯৪২ সালের ৮ মার্চ ফ্যাসিবাদ বিরোধী একটি সম্মেলনে রোলশ্রমিকদের মিছিল নিয়ে আসার পথে নৃশংসভাবে। তার প্রতিবাদে সারা বাংলার কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীরা বিক্ষোভে সোচ্চার হয়েছিলেন। এত বছর পরও সোমেনস্মৃতি এতটুকুও ম্লান হয়নি।
সোমেন চন্দের বাবার নাম নরেন্দ্রকুমার চন্দ এবং মা হীরণবালা দেবী। তবে তাঁদের পৈতৃকবাড়ি ছিল বর্তমান নরসিংদী জেলার বালিয়া গ্রামে। তাঁর তিন বছর বয়সে মা মারা গেলে পিতা দ্বিতীয় দার পরিগ্রহ করেন সরযু বিশ্বাস (পরে চন্দ) কে। এই সরযু চন্দই হয়ে ওঠেছিলেন সোমেন চন্দের প্রকৃত মা। কেননা অল্প বয়সেই মাতৃবিয়োগের ফলে কোনো স্মৃতিই তাঁর অবশিষ্ট ছিল না। মা সরযু চন্দের কাছেই প্রথম লেখাপড়ার পাঠ গ্রহণ করেন। ১৯৩২ সালের প্রথমেই তাঁকে পগোজ স্কুলে ভর্তি করা হয়। এ স্কুল থেকে ১৯৩৬ সালে দ্বিতীয় বিভাগে ম্যাট্রিক পাস করেন। তাঁকে মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুলে ভর্তি করা হয়। কিন্তু স্বাস্থ্যগত কারণে প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া ছেদ পড়ে। কিন্তু ঝুঁজে পড়েন মার্কসীয় সাহিত্য অধ্যয়নে। তাঁদের দক্ষিণ মৈশুণ্ডির জোড় পুল লেনে কমিউনিস্ট পাঠচক্রের প্রকাশ্য শাখা ছিল ‘প্রগতি পাঠাগার’। সেখানেই তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল আন্দামান ফেরৎ কমিউনিস্ট নেতা সতীশ পাকরাশি (১৮৯৮-১৯৭৩) এর সঙ্গে। সোমেন চন্দ সম্পৃক্ত হয়েছিলেন ‘প্রগতি পাঠাগার’, ‘প্রগতি লেখক সংঘ’ এবং পরে পূর্বাঞ্চলীয় রেল শ্রমিক ইউনিয়নের সঙ্গে। সোমেন চন্দের সাহিত্যচর্চার আগ্রহ সম্পর্কে বলতে গিয়ে সতীশ পাকরাশি লিখেছেন:
আন্দামান ফেরতা, টেররিস্ট বিপ্লবী দলের পুরানো কর্মী বলে, সে প্রথমটায় আমার দিকে আকৃষ্ট হয়। প্রথম দিনের পরিচয়েই আমি তাকে বলি,-সাহিত্য রচনার পথে ও বিপ্লবের কাজ হয়। তুমি দেশের দারিদ্র্য পীড়িত দুঃখী জনগণের আশা উদ্যমহীন জীবনের কথা দিয়ে জীবনের গণসাহিত্য তৈরি করো--তাহলে তোমার ঈপ্সিত স্বাভাবিক কর্মপথই ভবিষ্যৎ গণ বিপ্লবের পথ প্রস্তুতের সহায়ক হতে পারে। লেখার দিকেই তার বেশি টান এইটে বুঝেই ঐ কথা বলেছিলাম। সোমেন সব কথাই মনোযোগ দিয়ে শোনে কিন্তু কিছু বলে না। তবু তার আগ্রহ বোঝা যায়।
স্কুল জীবন থেকেই সোমেন চন্দ গল্প ও কবিতা লেখা শুরু করেন। পরে উপন্যাস ও নাটিকাও লিখেছেন। কিন্তু মূলত তিনি ছিলেন গল্পকার। এক সময় তাঁর গল্পে প্রগতি সাহিত্য তথা মার্কসীয় সাহিত্যের সুস্পষ্ট ছাপ পরিলক্ষিত হয়। ১৯৩৭ সালে প্রথম তাঁর শিশু-কিশোর বিষয়ক গল্প ‘শিশু তপন’ সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সেখানে জীবনশিল্পী বিভুতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের রচনার প্রতিচ্ছাপ থাকলেও পরে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ও মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। তিনি লেখালেখিতে দায়বোধের দিকটি বিবেচনা করেই বন্ধু অমৃতকুমার দত্তকে এক চিঠিতে লিখেছেন:
গত কয়েকদিন রেল শ্রমিকদের নিয়ে বেশ ঝামেলায় ছিলাম। লেখার জন্য একটুও সময় পাই না। তবু লিখতে হবে, মেহনতী মানুষের জন্য, সর্বহারা মানুষের জন্য, আমাদের লিখতে হবে। র্যালফ ফক্সের বই পড়ে আমি অন্তরে অনুপ্রেরণা পাচ্ছি। কডওয়েলের বইটিও আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। এই না হলে কি মহৎ সাহিত্যিক হওয়া যায়? স্পেনের পপুলার ফ্রন্ট সরকারের সমর্থনে তাঁদের আত্মবিসর্জন ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। আসার কথা বাংলা সাহিত্যের তরুণ লেখকরা এ দিকে সচেতন হচ্ছে।
ইতোমধ্যেই তিনি পড়ে ফেলেছেন টিএস এলিয়ট, অডেন, স্টিফেন স্পেন্ডার, ভার্জিনিয়া উলফ, হাক্সলি, ই.এম. ফর্স্টার, হেমিংওয়ে, ম্যাক্সিম গোর্কি, আঁন্দ্রে জিদ, র্যালফ ফক্স, কডওয়েল, অ্যাপ্টন সিনক্লেয়ার, ম্যাৎসিনি, রম্যাঁ রোল্যাঁ, মার্কস, লেনিনসহ নামকরা লেখকদের গ্রন্থাদি। তারই ছাপ পড়েছে সোমেন চন্দের লেখালেখিতে। মাত্র পাঁচ বছরের সাহিত্য জীবনে (১৯৩৭-১৯৪২) তাঁর ২৯টি গল্প, ৩টি কবিতা, ২টি একাঙ্কিকা, ১টি উপন্যাস এবং ৭খানা চিঠিপত্র প্রকাশের কথা জানা যায়। তবে অপ্রকাশিত একটি গল্প ‘দুই পরিচ্ছেদ’ এবং অপর একখানা উপন্যাসের প্রসঙ্গ অবশ্য জানা গেছে। সোমেন চন্দের গল্পসমূহ প্রকাশের ধারাবাহিক খতিয়ান তুলে ধরা হল। ১৯৩৭-শিশু তপন (সাপ্তাহিক দেশ), অন্ধ শ্রীবিলাসের অনেক দিনের একদিন (সাপ্তাহিক অগ্রগতি), মরুভূমিতে মুক্তি (সাপ্তাহিক অগ্রগতি), রানু ও স্যার বিজয়শংকর (সাপ্তাহিক সবুজ বাংলার কথা), এক্স সোলজার (সাপ্তাহিক সবুজ বাংলার কথা), পথবর্তী (মাসিক শান্তি) ও ভালো-না-লাগার শেষ (সাপ্তাহিক অগ্রগতি); ১৯৩৮-স্বপ্ন (রবিবাসরীয় আনন্দবাজার), সংকেত (রবিবাসরীয় আনন্দবাজার), অমিল (সাপ্তাহিক সবুজ বাংলার কথা), সত্যবতীর বিদায় (মাসিক শান্তি), মুখোস (নবশক্তি) ও পথের শেষ (অরণি); ১৯৩৯- আমরা তিনজন (বলাকা) ও সিগারেট (শান্তি); ১৯৪০-গান (মাসিক বালিগঞ্জ), প্রত্যাবর্তন (মাসিক ঊালিগঞ্জ), মহাপ্রয়াণ (মাসিক ঊালিগঞ্জ), প্রান্তর (মাসিক ঊালিগঞ্জ) ও বনস্পতি (ক্রান্তি); ১৯৪১- উৎসব (স্মৃতি-শারদীয় সংকলন); ১৯৪২ (মৃত্যুরপর)- মুহূর্ত (সাপ্তাহিক অরণি), রাত্রিশেষ (সংকেত ও অন্যান্য গল্প), একটি রাত (সংকেত ও অন্যান্য গল্প), দাঙ্গা (সাপ্তাহিক প্রতিরোধ), ইঁদুর (মাসিক পরিচয়) ও অকল্পিত (সাপ্তাহিক প্রতিরোধ); ১৯৪৩- মরুদ্যান (বনস্পতি) এবং ১৯৮০-রাজপুত্তুরের গল্প (আলোর ফুলকি)। উল্লেখ্য যে, একটি রাত, রাত্রিশেষ, মরুদ্যান ও রাজপুত্তুরের গল্প গ্রন্থথিত হওয়ার আগে অন্য কোথাও ছাপা হয়েছিল কিনা জানা যায় নি। ধারণা করা হয় যে, রাজপুত্তুরের গল্পটি তার প্রথম দিকের লেখা। ‘ইঁদুর’ গল্পটি গরপব নামে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন অশোক মিত্র এবং তা অন্যান্য ভারতীয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ‘সংকেত’ গল্পটিও ঝরমহ নামে ইংরেজিতে অনুবাদ করেন লীলা রায়।
সোমেন চন্দ মার্কসীয় রাজনীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তাই ঘুরে ফিরে তাঁর অধিকাংশ গল্পে রাজনীতির কথা স্থান লাভ করেছে। কেননা তিনি নিজেই বলেছেন:
বিপ্লবের জন্য একজন লেখক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। আমাদের সেভাবে প্রস্তুত হতে হবে। গোর্কির কথাই চিন্তা করো। শৌখিন সাহিত্য করার আর সময় নেই।
আর সাহিত্যচর্চার ব্যাপারে তিনি মহামতি লেনিনের বাণীকেই মূর্তিমান করতে সচেষ্ট ছিলেন। ঠিক যেমনটা লেনিন বলেছেন:
...সাহিত্য কোনো একক ব্যক্তি বা দলকে সমৃদ্ধ করার মাধ্যম হতে পারে না; বস্তুত তা সর্বহারা শ্রেণির সাধারণ লক্ষ্য নিরপেক্ষ কোনো ব্যক্তিগত প্রচেষ্টাও হতে পারে না।...সাহিত্যকে অবশ্যই সর্বহারা শ্রেণির সাধারণ লক্ষ্যের অংশ হতে হবে।
সোমেন চন্দের সাহিত্যচর্চার প্রায় সর্বত্র তাঁর রাজনৈতিক দর্শনের কিছু না কিছু ছাপ সুস্পষ্ট হয়েছে। তবুও তাঁর গল্পগুলোতে মানবজীবনের অন্তর্নিহিত ভাব, নরনারীর প্রেম, দাম্পত্যজীবনের নানা সহজসরল মধুর গল্প রয়েছে। গান, ভালো-না-লাগার শেষ, রাত্রি শেষ, মরুভূমিতে মুক্তি ও আমরা তিনজন। তিনি লিখেছেন সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত, আবেগ-অনুভূতির গল্প। যেমন- মরুদ্যান, অন্ধ শ্রীবিলাসের অনেক দিনের একদিন, পথবর্তী, সত্যবতীর বিদায়, মুহূর্ত, মুখোস, রানু ও স্যার বিজয় শংকর, এক্স সোলজার, সিগারেট, উৎসব, পথের শেষ ইত্যাদি। তাঁর লেখায় রাজনৈতিক চেতনা বিকাশের কথাও রয়েছে; সংকেত, একটি রাত, স্বপ্ন, ইঁদুর, দাঙ্গা, বনস্পতি, পথবর্তী, প্রান্তর প্রভৃতি। রাজনীতির মতো ভারিক্কি গল্পের পাশাপাশি তাঁর ব্যঙ্গবিদ্রƒপাত্মক গল্প মহাপ্রয়াণ, অকল্পিত, অমিলও রয়েছে। এমনকি শিশুদের জন্য ও তিনি লিখেছেন-শিশু তপন ও রাজপুত্তুরের গল্প। এসব দিক বিবেচনা করে তাঁকে জাত জীবনশিল্পী হিসেবেই আখ্যায়িত করা যায়।
সোমেন চন্দের গল্পে কখনো কখনো তিনি নিজেই প্রধান চরিত্র হয়ে ওঠেছেন। কখনোবা গোটা পরিবারই গল্পের চরিত্র রূপে প্রতিভাত হয়েছে। মহান জীবনশিল্পী গোর্কির একান্ত ভক্ত সোমেন চন্দ ‘মা’ উপন্যাসের পাভেল চরিত্রের প্রতিরূপ অঙ্কন করেছেন সুকুমারকে ‘একটি রাত’ গল্পে। সুকুমারের ‘মা’ গোর্কির মা পড়ছেন দেখে সুকুমার বলছে:
তুমিও এই বই পড়ছ, মা? দোষ আছে কে বললে? কিছু দোষ নেই। তুমি সত্যি সত্যিই পাভেলের মা হতে পারবে। আমি অবশ্য পাভেলের মতো হতে এখনও পারিনি। তবে হব।
সোমেন চন্দের গল্পের চরিত্রচিত্রণে সজীবতা ও বাস্তবতার দিক প্রসঙ্গে তাঁর অনুজ কল্যাণ চন্দ লিখেছেন:
দাদার শেষের দিকের গল্পগুলির চরিত্রসমূহ যে জীবন্তরূপ পেয়েছে তার অন্যতম কারণ, আমরা বাবা-মা-ভাই-বোন এবং দাদা যেমন ছিলেন তাকেই সাহিত্যসম্মতরূপে দাদা লিখেছেন। আমরাতো ‘দাঙ্গা’, ইঁদুর’ গল্পে যেমনটা বর্ণিত প্রায় এমনটিইতো ছিলাম।
সোমেন চন্দের অন্যতম শ্রেষ্ঠগল্প ‘ইঁদুর’। এ গল্পের প্রধান চরিত্র ইয়াছিন (নিজের চরিত্রেরই সুন্দর পরিস্ফুটন) গল্পের শেষে বলছে:
আমি ফিরে এলুম। সাম্যবাদের গর্ব, আর ইস্পাতের মতো আশা, তার সোনার মতো ফসল বুকে আমি ফিরে এলুম।
সোমেন চন্দ রাজনৈতিক কর্মী। তাঁর গল্পের অনেক স্থানে রাজনৈতিক স্লোগান প্রতিবিম্বিত হলেও কোনো কোনো গল্পে ইতিহাসবোধ ও নিরেট বাস্তবতার ছবি অঙ্কিত হয়েছে। যেমন মাধবদীর মেলা, ১৭৫৭ সাল বা পল্টনের মাঠ প্রভৃতি ইতিহাসেরই অমূল্য উপাদান। তাঁর ‘দাঙ্গা’ গল্পে তো ঢাকায় ১৯৪০-১৯৪১ সালের বিরাজমান পরিস্থিতিই বিবৃত হয়েছে। দাঙ্গা গল্পের খানিকটা এখানে তুলে ধরা হল:
এমন সময় কথাবার্তা নেই দুটি ছেলে এসে হাজির, তাদের মধ্যে একজন কোমর থেকে একটা ছোরা বের করে লোকটার পিছনে একবার বসিয়ে দিল। লোকটা আর্তনাদ করে উঠল, ছেলেটি এতটুকু বিচলিত হল না, লোকটার গায়ে যেখানে সেখানে আর তিনবার ছোরা মেরে তারপর ছুটে পালাল, কুকুর যেমন লেজ তুলে পালায় তেমনি ছুটে পালাল। লোকটা আর্তনাদ করতে করতে গেইটের কাছে গিয়ে পড়ল, তার সমস্ত শরীর রক্তে ভিজে গেছে, টাটকা লাল রক্ত, একটু আগে দেখেও মনে হয়নি এত রক্ত ওই কঙ্কালসার দেহে আছে।
সোমেন চন্দের সাহিত্য মূল্যায়ন অনেকেই করেছেন। তবে বাংলাসাহিত্যের কালজয়ী কথাশিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন:
নিজস্ব একটি জীবনদর্শন না থাকলে সাহিত্যিক হওয়া যায় না। সোমেন চন্দ ছিল কমিউনিস্ট। সাহিত্যিক হিসেবেও তার রচনায় নানাভাবে ফুটে ওঠেছে কমিউনিজমের জয়ধ্বনি।
বিশিষ্ট সাহিত্য সমালোচক গোপাল হালদার লিখেছেন:
সোমেন কল্পনায় বাহুল্য নেই, তাহার লেখাও স্বচ্ছ ও স্বাচ্ছন্দ। তবু একথা বারে বারে মনে হইবে-তাহার প্রতিভা পূর্ণতা লাভ করিতে পারে নাই।... এখানেই তাহার সঙ্গে কিটসের মিল--তাহারও রহিল ‘An inheritance unfulfilled reunion’, নইলে কিট্স ও সোমেন এক জাতের নয়। বরং সোমেনের গল্প পড়িতে পড়িতে যাহার কথা বেশি মনে পড়ে, সে কিট্স নয়--গোর্কি। জানি না কেন।
শিল্প-সাহিত্যের চুলচেরা সমালোচনা ও সূত্র বিশ্লেষক রণেশ দাশগুপ্ত সোমেন চন্দের ‘দাঙ্গা’ গল্পটি সম্পর্কে মন্তব্য করে বলেছিলেন ‘একটুও খুঁত নেই’। তিনি লিখেছেন:
সাম্যবাদের স্বপ্ন দেখতেন সোমেন ঠিকই কিন্তু সাম্যবাদ যারা আনছেন তাদের উপর তিনি তাঁর স্বপ্নকে আরোপ করেননি, তাদের বাস্তব জীবনের অভিজ্ঞতাও সংগ্রামের মধ্যদিয়ে স্বপ্নকে বেরিয়ে আসতে দেখেছেন। এদিক দিয়ে সোমেন চন্দকে বাংলা ছোট গল্পের সমাজতান্ত্রিক বাস্তববাদীদের পথিকৃৎ বলা যেতে পারে।
সাতাত্তর বছর আগে ফ্যাসিবাদী চরেরা সোমেন চন্দকে খুন করলেও তিনি অমর হয়ে আছেন। তাঁর জন্মশতবাষির্কীতে আমাদের শত শ্রদ্ধাঞ্জলি শত-শতবার।
তথ্যসূত্র:
- সোমেন চন্দ গল্পসংগ্রহ-সম্পাদনা: পবিত্র সরকার, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা।
- সোমেন চন্দ ও প্রগতি সাহিত্য আন্দোলন-বীরেন্দ্রমৃধা আশাদীপ, কলকাতা।
- আগুনের অক্ষর: সোমেন চন্দ স্মারকগ্রন্থ-সম্পাদনা: কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত, পবিত্র সরকার, সোমেন চন্দ ৭০তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন সমিতি, কলকাতা।
- পূর্বমেঘ, সোমেন চন্দ শতবর্ষ স্মরণ সংখ্যা-সম্পাদনা: মণীশ চক্রবর্তী, আগরতলা অক্টোবর ২০১৮-মার্চ ২০১৯।
- সোমেন চন্দ রচনাবলি-সংকলন ও সম্পাদনা: বিশ্বজিৎ ঘোষ, কথাপ্রকাশ, ঢাকা।
- অমিত্রাক্ষর সোমেন চন্দ পুরস্কার ২০১১-সম্পাদনা: আমিনুর রহমান সুলতান, ঢাকা।