/  Blogs   /   ভাষা আন্দোলনে অবাঙালিদের ভূমিকা
g

ভাষা আন্দোলনে অবাঙালিদের ভূমিকা

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির আগে থেকেই ভাষার প্রশ্নটি সামনে চলে আসে। ১৯৪৭ সালের ১৯ মে হায়দ্রাবাদে এক উর্দু সম্মেলনে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের এক প্রভাবশালী নেতা ঘোষণা করেন যে, ‘উর্দুই পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হইবে।’ তাছাড়া সে বছর জুলাই মাসের মধ্যভাগে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন। তারই প্রতিবাদে কাজী আবুল হোসেন (পূর্বপাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, দৈনিক আজাদ ২১ জুলাই ১৯৪৭), এ কে এম নূরুল হক বিএ (পাকিস্তানের ভাষা সমস্যা, দৈনিক আজাদ, ২৯ জুলাই ১৯৪৭), আয়েশা বেগম (ভাষা সমস্যা, দৈনিক আজাদ, ৫ অক্টোবর ১৯৪৭) প্রমুখ লেখালেখি করেন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান সৃষ্টির অর্ধমাসের পরপরই ঢাকাতে ‘তমদ্দুন মজলিস’ একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। এ প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগেই ১ অক্টোবর প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সে আন্দোলন প্রচণ্ড গতিবেগ লাভ করে এবং ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বিশ্বের বুকে বাঙালি ভাষার প্রশ্নে প্রথম রক্ত দিয়ে মাতৃভাষা বাংলার প্রতিষ্ঠা লাভ করে। এই বীরত্বপূর্ণ লড়াই সংগ্রামে কিছুটা হলেও  অবাঙালিরাও সমর্থন সহযোগিতা করেছেন সে দিকটি নিয়ে তেমন একটি আলোচনা বা লেখালেখি হয়নি। এখানে কিছুটা হলেও সে বিষয়টি নিয়ে দৃকপাত করার প্রয়াস নেয়া হয়েছে।

১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ থেকে ১৯৫২ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছিল ভাষা আন্দোলনের উত্তাল সময়। তার আগে পরে ও ভাষা-আন্দোলন চলেছে। অবাঙালিরা ভাষা-আন্দোলনের প্রতি সমর্থন-সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। ১৯৫১ সালের ২০ এপ্রিল পেশোয়ারে ‘খাইবার মেল’ পত্রিকায় লেখা হয়েছিল:

বাংলা ভাষার দাবী কিছুতেই অবহেলা করা চলে না। পাকিস্তানের জনসংখ্যার অধিকাংশই পূর্বপাকিস্তানের অধিবাসী এবং বাংলা ভাষার এক নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাহিত্য আছে। উর্দুকে কাহারও উপর চাপাইয়া দেওয়া চলে না। সুইজারল্যান্ডে ইংরেজি, জার্মানি ও ফরাসি তিনটি ভাষাই বিভিন্ন এলাকায় ব্যবহৃত হয়ে থাকে। কানাডায় ইংরেজি ও ফরাসি ভাষা সরকারীরূপে পরিগণ্য।

তাছাড়া ১৯৫১ সালের ১৩ মে ‘লাহোরের চিঠি’-তে ‘বাংলাভাষা ও পশ্চিম পাকিস্তান’-এ বাংলাভাষার প্রতি সমর্থন দেখিয়েছেন। বাংলা দেশের অবাঙালিরা বেশিরভাগ স্বার্থান্বেষী মানুষ বাংলাভাষার প্রতি বিরূপ মনোভাব  প্রদর্শন করেছেন, ভাষা আন্দোলনের বিরোধিতা করেছেন অনেকে প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে সমর্থন ও করেছেন। শুধু তা কেন অনেক বাংলাভাষা-ভাষী মানুষও ভাষা-আন্দোলনের বিরোধিতা করেছেন। খাজা নাজিমউদ্দিন, নূরুল আমীন গংরা ছিলেন। ষাটের দশকেও দেখেছি অনেক বাঙালিরা উর্দুভাষায় বাতচিৎ করে বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। দেখতে চেয়েছেন তাদের আভিজাত্যের অবস্থাটি। কিন্তু মানুষমাত্রই দরদী ও সংবেদনশীল। ১৯৫২ সালের ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি যখন ছাত্র-জনতার মিছিলে গুলি চলে, তখন মেডিকেল কলেজ ব্যারাক হোস্টেল ও বিশ্ববিদ্যালয় হল থেকে মাইকে হরতাল-মিছিলের পক্ষে প্রচারণা চালানো হয়। সেখানে জনমত সৃষ্টির লক্ষ্যে উর্দুভাষাও প্রচার চালানো হয়। বর্বর পুলিশি আক্রমণের প্রতিবাদ ও নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়। তাতে মেডিকেল কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ও অন্যান্য কলেজের প্রগতিশীল ছাত্ররা অংশ নিয়েছেন। উর্দুভাষায় প্রচারপত্র ছেপে প্রচার করেছেন। অনেকে ভাষা-আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করার ফলে জেল খেটেছেন। এ-প্রসঙ্গে স্মৃতিচারণ করে তৎকালীন জগন্নাথ কলেজের আইএ ক্লাসের ছাত্র নোয়াখালীর নিয়ামুল বশীর বলেছেন:

একদিন নবাবপুর রোড়ে বাংলা ভাষার দাবী সম্মলিত উর্দুপ্রচারপত্র বিলি করছি, উর্দুভাষী একজন লোক আমাকে পাকড়াও করে আমাকে বললেন যে, আমি উর্দুভাষীদের উর্দুর বিরুদ্ধে কোন কাজ করছি।... তাকে বলেছিলাম যে, বাংলাভাষার দাবী প্রতিষ্ঠার জন্য এ কাজ করা হচ্ছে, উর্দু ভাষার বিরুদ্ধে কিছু করা হচ্ছে না। কিন্তু তিনি কিছুতেই বুঝতে চান না। আরো লোক জমা হয়ে গিয়েছিল। আমি বিপন্ন হয়েছিলাম এবং কোনো রকমে রক্ষা পেয়েছিলাম।

তাঁর স্মৃতিচারণে ভাষা-আন্দোলনে অবাঙালিদের অংশগ্রহণের আরো কিছু প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি লিখেছেন:

সে সময়ে আরো বেশ কিছু উর্দুভাষী আমাদের এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। মনে পড়ে, সে সময়ে সালাউদ্দিন মোহাম্মদ এই ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং ’৫২ সালে আমরা যখন জেলে যাই তখন সালাউদ্দিন মোহম্মদের এক ভাইও কারা বরণ করেন বলে মনে পড়ছে। তাছাড়া আরো অনেক উর্দুভাষী ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী এ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তাঁরা বাংলা একদম জানতেন না। আমি বাংলা থেকে উর্দুতে তরজমা করে দিতাম এবং সালাউদ্দিন মোহাম্মদ সেগুলোর ভুলভ্রান্তি সংশোধন করে দিতেন। পরে সেগুলো উর্দু দৈনিকে ছাপা হত।

করাচীর মেথরান হোস্টেলের ছাত্ররা এক তারবার্তায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মিছিলে পুলিশের গুলিচালনার তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং শহীদ ছাত্রদের আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি গভীর সমবেদনা প্রকাশ করেন। তাঁরা এ ঘটনার তদন্ত করে প্রকৃত দোষীদের প্রকৃত শাস্তিবিধানের জন্য সরকারকে অনুরোধ করেন। তাছাড়া শহীদদের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে করাচীর পত্রিকাসমূহে পুলিশের গুলিবর্ষণের তদন্ত দাবী করে প্রবন্ধ প্রকাশ করে ‘ইভনিং স্টার, ইভনিং টাইমস পত্রিকা দুটিতে ঢাকায় সাম্প্রতিক গুলিবর্ষণ সম্পর্কে তদন্ত দাবী করেছেন এবং শহীদদের উদ্দেশে গভীর শোক প্রকাশসহ শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেছেন। ২৩ লাহোরের গণতান্ত্রিক ছাত্র ফেডারেশনের কার্যনির্বাহী কমিটি ঢাকার ছাত্রদের উপর পুলিশের গুলিবর্ষণের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেছেন। তাছাড়া তাঁরা সভা করে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে গুলিবর্ষণের তদন্ত দাবী করেছেন। ১৯৫৩ সালের ২৮ জানুয়ারি দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশ করা হয় যে, গণতন্ত্রী দলের এক সম্মেলনে পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যতম বাম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব সরকার শওকত হায়াত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জানিয়েছেন।

১৯৫২ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা বার এসোসিয়েশন বলে পূর্ব পাকিস্তান সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কার্যপরিষদের যে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় তাতে উর্দু প্রগতি লেখক হাসান পারভেজ উর্দুতে বক্তৃতা করতে গিয়ে বলেছেন:

বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবী সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক। তার প্রতি আমাদের কোনো বিদ্বেষভাব থাকতে পারে না। আমরা প্রাণপণে এ-দাবী সমর্থন করে যাবো।

বাংলাদেশের প্রগতিশীল সাহিত্যচর্চায় ও ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ছায়াপাত ঘটেছে। কলিম আহমদ-র ‘হারানো স্বপ্ন’ গল্পটি ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে রচিত। ১৯৬৯ সালে রুদাদ এবং ১৯৭০ সালে জবীদা সাপ্তাহিক দুটিতে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রকাশ লক্ষ করা যায়। পত্রিকা দুটির সম্পাদক ছিলেন বিখ্যাত উর্দু কবি নওশাদ নূরী। এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন গোলাম মোহাম্মদ। মুক্তিযুদ্ধের পূর্ব পর্র্যন্ত এ-দুটি পত্রিকা ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছিল। অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে এ-পত্রিকা দুটো সোচ্চার ছিল। তাছাড়া গোলাম মোহাম্মদের ‘হায়েনা’ গল্পটি মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকায় রচিত হয়েছে এবং আইয়ুব জংয়ের ‘বিসমিল্লাহ’ গল্পে মানকি চেতনার প্রকাশ ঘটেছে।

মহান ভাষা আন্দোলনে বীর বাঙালিদের অবদানের পাশাপাশি অবাঙালিদেরও কিছুটা অবদানের কথা স্বীকার করায় বাঙালির গৌরব কোনোভাবেই কমবে না; বরং মর্যাদা অনেকটাই বৃদ্ধি পাবে। শহিদ স্মৃতি অমর হোক। 

তথ্যপঞ্জি:

  • বিচিত্র, একুশে ফেব্রুয়ারি বিশেষ সংখ্যা ১৯৯৯
  • ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস কয়েকটি দলিল, বাংলা একাডেমি
  • মো. মোখলেছুর রহমান, সাবেক অধ্যক্ষ ও বিশিষ্ট রাজনীতিক
f
Elephant Road, Dhaka 1205 +8809606033393 [email protected]
Free shipping
for orders over ৳1,999