/  Blogs   /   ফ্যাসিবাদ ও যুদ্ধ-বিরোধী রবীন্দ্রনাথ
g

ফ্যাসিবাদ ও যুদ্ধ-বিরোধী রবীন্দ্রনাথ

রবীন্দ্রনাথের জন্ম কোলকাতায় জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে। বাংলার সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি ও স্বাদেশিকচেতনা উন্মেষে যে পরিবার বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। রবীন্দ্রনাথের (১৮৬১-১৯৪১) বয়স যখন পাঁচ বছর, ১৮৬৬ সালে ঠাকুর পরিবারের সুহৃদ, রবীন্দ্রনাথের গৃহশিক্ষক রাজনারায়ণ বসু (১৮২৬-১৮৯৯) কোলকাতায় প্রতিষ্ঠা করেন ‘জাতীয় গৌরবেচ্ছা সভা’ এবং হিন্দুমেলা (১৮৬৭)। পরবর্তী সময় থেকে এ মেলার নামকরণ করা হয় ‘চৈত্র মেলা’। স্বাদেশিকতাবোধ সৃষ্টির লক্ষ্যেই ১৮৭৮ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘সঞ্জিবনী সভা’। কিশোরকাল থেকেই রবীন্দ্রনাথ এসব কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর আত্মপরিচয় গ্রন্থে লিখেছেন:

জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর বৈপ্লবিক ভাবধারায় অনুপ্রাণিত হয়ে বৈপ্লবিক সংগঠন ‘সঞ্জিবনী সভা’ নামে একটি গুপ্ত সমিতি স্থাপন করেছিলেন। সমিতির সভাপতি ছিলেন হিন্দুমেলার উদ্যোক্তা রাজনারায়ণ বসু এবং সভ্য ছিলেন নবগোপাল মিত্র ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

‘সঞ্জিবনী সভা’-র কর্মকাণ্ডের কিছু বিবরণ দিয়ে একই গ্রন্থে রবীন্ত্রনাথ লিখেছেন:

যোতিদাদা এক পোড়ো বাড়ীতে এক গুপ্ত সভা স্থাপন করেছেন। একটা পোড়ো বাড়ীর তার অধিবেশন, ঋগবেদের পুঁথি, মড়ার মাথার খুলি আর খোলা তলোয়ার নিয়ে তার অনুষ্ঠান, রাজনারায়ণ বসু তার পুরোহিত। সেখানে আমরা ভারত উদ্ধারের দীক্ষা পেলাম।

রবীন্দ্রনাথ সারাজীবন কোনো রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্কিত না থেকেও ছোটবেলা থেকে ঠাকুর পরিবারে এক স্বাদেশিক পরিবেশে বেড়ে ওঠেছেন। ১৮৮৫ সালে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর ১৮৮৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর কোলকাতায় যে দ্বিতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় সেখানে নিজের লেখা গান ‘আমরা মিলেছি আজ মায়ের ডাকে’ পরিবেশন করেন। তারপর ১৮৯২ সালের কোলকাতা অধিবেশনেও গেয়েছিলেন বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা ‘বন্দেমাতরম’ গানটি। আরও অনেক অধিবেশনেও তিনি যোগদান করেছেন, গান করেছেন। আর বিংশ শতকের শুরুতে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী যে তুমুল স্বদেশী আন্দোলনের সূচনা হয়, তাতে সশরীরে অংশ নিয়েছেন, গান লিখেছেন ও গান করেছেন। সে সব গানতো পরবর্তী সময়ে বিপ্লবীদের জীবনদানের অস্ত্র হয়ে উঠেছিল। কিন্তু বিপ্লবী আন্দোলন প্রবল হয়ে ওঠলে তিনি স্বদেশী আন্দোলন থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেন। কেননা রবীন্দ্রনাথ কোনোদিন সহিংসতাকে প্রশ্রয় দেননি। তবে বিপ্লবীদের উপর নিষ্ঠুর নির্যাতন-নিপীড়ন ও তিনি সমর্থন করেননি। পরোক্ষভাবে হলেও অনেক সময় তিনি বিপ্লবীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। ১৯১৫ সালে বুড়িবালামের যুদ্ধে যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় (বাঘা যতীন)-এর মৃত্যু সংবাদ শুনে তিনি বলেছিলেন, ‘এতকালের পরাধীন দেশে এ মৃত্যুও ছোট নয়। কিন্তু যতীনের সাধনা বলার পর তাঁর ঠোট দুটো কেঁপে কেঁপে থেমে গিয়েছিল।’ ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগের  নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পরতো তিনি ঘৃণাভরে ‘নাইট’ উপাধি” প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।

১৯২৯ সালে বিপ্লবী যতীন দাস (১৯০৪-১৯২৯) জেলখানায় ৬৩ দিন অনশন করার পর মারা গেলে রবীন্দ্রনাথ ব্যথিত হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠ সহযোগী শান্তিদেব ঘোষ লিখেছেন:

শেষ পর্যন্ত যতীন দাসের মৃত্যু হল। সেই সংবাদ যখন শান্তিনিকেতনে এসে পৌঁছল, সেইদিন গুরুদেব মনে যে বেদনা পেয়েছিলেন, তা ভুলবার নয়। সন্ধ্যায় ‘তপতি’ অভিনয়ের মহড়া বন্ধ না রাখার কথা হল। কিন্তু বারবার তিনি তার পাঠের খেই হারাতে লাগলেন, বহুবার চেষ্টা করেও কিছুতেই ঠিক রাখতে পারছিলেন না, অন্যমনস্ক হয়ে পড়ছিলেন। শেষ পর্যন্ত মহড়া বন্ধ করে দিলেন। সেই রাত্রেই লিখলেন ‘সার্বখর্বতারে দহ তব ক্রোধদাহ’ গানটি।

কোলকাতা, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও দেশের অন্যান্য স্থানে বিপ্লবীদের ওপর যে নিপীড়ন ও নির্যাতন চলছিলো সে সম্পর্কেও রবীন্দ্রনাথ অবহিত ছিলেন। ১৯৩০ সালে তিনি একবার বলেছিলেন, ‘আমার চিত্ত আমার দেশের সঙ্গে প্রবল বেদনায় সম্মিলিত হয়েছে।’ সে বছর অক্সফোর্ডে হিলবার্ট বক্তৃতা দিতে গিয়ে স্বদেশী ছাত্রদের প্রশ্ন ছিলো কেন তিনি এ সময় গান্ধীজির আইন অমান্য আন্দোলনে তার পাশে থাকেননি। তিনি শান্ত ও বিষণ্ন মনে উত্তর দিয়েছিলেন, ‘তোমরা বুঝবেনা। কিন্তু গান্ধীজি জানেন আমার নিজস্ব হাতিয়ার নিয়ে একই লড়াইয়ে আমি রয়েছি।’ তারপর তিনি ‘দুঃসময়’ কবিতাটি আবৃত্তি করেছিলেন।

১৯৩১ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর হিজলি ও চট্টগ্রাম জেলে রাজবন্দিদের উপর নির্মম নির্যাতনের প্রতিবাদে কোলকাতার গড়ের মাঠে মটারলোনি মনুমেন্টের পাদদেশে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সে সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। সভাপতির ভাষণে তিনি বলেছিলেন:

প্রথমেই বলে রাখা ভালো, আমি রাষ্ট্রনেতা নই, আমার কর্মক্ষেত্র রাষ্ট্রিক আন্দোলনের বাইরে। কর্তৃপক্ষকৃত কোনো অন্যায় বা ত্রুটি নিয়ে সেটাকে আমাদের রাষ্ট্রীয় খাতায় জমা করতে আমি বিশেষ আনন্দ পাইনে। এই যে হিজলির গুলি চালানোর ব্যাপারটি আজ আমাদের আলোচ্য বিষয় তার শোচনীয় কাপুরুষতা ও পশুত্ব নিয়ে যা-কিছু আমার বলবার সে কেবল অবমানিত মনুষ্যত্বের দিকে তাকিয়ে।

তাছাড়া জেলখানায় রাজবন্দীরা যে নিদারুণ অর্থকষ্টে জীবনযাপন করেছেন এ দিকটিও রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি এড়ায়নি। এ ব্যাপারে তিনি ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের (১৮৯০-১৯৭৭) সঙ্গে পত্রে আলোচনা করেছেন। তিনি মহিলা রাজবন্দি বিশেষ করে কল্পনা দত্তের (১৯১৩-১৯৯৫) মুক্তির ব্যাপারে চেষ্টা করেছেন। আন্দামান জেলে রাজবন্দিদের অনশনে মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ১৩৪৪ সালের ২৯ শ্রাবণ শান্তিনিকেতনে ছাত্রছাত্রী ও অধ্যাপকদের এক সভায় তিনি বলেছিলেন:

নির্জন কারাবাস বা আন্দামানে নির্বাসন আমি কোনো প্রকার অপরাধীর জন্য সমর্থন করিনে, যারা দেশবাসীর প্রতিনিধির পদে উচ্চাসনে সমাসীন তারা যদি মনে করেন আমি নীচে দাঁড়িয়ে তাদের প্রতিবাদ করব।

তবে রবীন্দ্রনাথ বেশি উদ্বেলিত হয়েছিলেন বিগত শতাব্দীর বিশ-ত্রিশের দশকে ইউরোপে জেগে ওঠা ফ্যাসিবাদের অভ্যুদয়ে এবং মানবতা বিধ্বংসী সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের আশঙ্কায়। ১৯১৯ সালের বসন্তকালে ইতালিতে প্রথম ফ্যাসিস্টগোষ্ঠীর আবির্ভাব ঘটে মুসোলিনির নেতৃত্বে। তারই প্রতিক্রিয়ায় ১৯২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কমিউনিস্টদের উদ্যোগে ‘ফ্যাসিবিরোধী মৈত্রী’ নামে একটি ফ্রন্ট গঠিত হয়। এ ফ্রন্টের আহ্বানে সে বছর আগস্ট মাসে প্রথম  ফ্যাসিবিরোধী ধর্মঘট পালিত হয়। অপরদিকে ফ্যাসিস্টরা ২৮ অক্টোবর রোম অভিযান চালায়। সে সময় মুসোলিনিকে ইতালির প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করা হয়। ১৯২৩ সালে কমিউনিস্টদের  ব্যাপকভাবে নিপীড়ন-নির্যাতন ও গ্রেপ্তার করা হয়। তবে এসব ঘটনা বহির্বিশ্বে খুব কমই প্রচারিত হয়েছে। চাকচিক্যময় উন্নয়নের আবরণে তা ঢেকে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ১৯২৬ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন রোম ভ্রমণ করেন, তখন তার সম্মানে মুসোলিনির দেয়া রাষ্ট্রীয় ভোজসভায় অভিভূত হয়ে রবীন্দ্রনাথ ও প্রশংসাসূচক বক্তব্য রেখেছিলেন। তবে তার সে ভুল ভাঙতে বেশি দেরি হয়নি। ফ্রান্সে রঁমা রোলাঁর সঙ্গে আলাপ করেই তিনি জানতে পেরেছিলেন ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির আসল রূপ। যুদ্ধের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা কব্জা করাই তাদের লক্ষ্য। তার বিরুদ্ধে জনমত গঠনের জন্য বিবেকবান কবি, সাহিত্যিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী, বুদ্ধিজীবীরা মিলে ১৯২৭ সালে গঠন করেছিলেন সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ বিরোধী লীগ (১৯২৭-১৯৩৫)। সে বছর অ্যারি বারবুস ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে একটি আবেদনে স্বাক্ষর করার জন্য রবীন্দ্রনাথকে একটি পত্র লেখেন। আবেদনে স্বাক্ষর করে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন:

এটা বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, আপনার আহ্বানে আমার সহানুভূতি আছে এবং আমি নিশ্চিতভাবে মনে করি যে এটা অন্যান্য অসংখ্য মানুষের কণ্ঠস্বরের প্রতিনিধিত্ব করে আর যারা সভ্যতার গর্ভ থেকে হিংসার আকস্মিক বিস্ফোরণে হতাশ বোধ করছেন...।

১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথ রাশিয়া গেলেন। সেখানকার সমাজব্যবস্থা, শিক্ষাব্যবস্থা ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দেখে অভিভ‚ত হলেন। তারপর থেকেই তিনি শান্তি আন্দোলনের প্রতি অধিক আগ্রহী হয়ে ওঠেন। ১৯৩১ সালে জাপান মাঞ্চুরিয়া আক্রমণ করে। তিনি জাতীয়তাবাদের নামে আগ্রাসনকে নিন্দা করেন। ১৯৩২ সালের ২৭-২৯ আগস্ট  আমস্টারডামে আন্তর্জাতিক যুদ্ধবিরোধী কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন অ্যারি বারবুস। বিশ্বের কবি, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানানো হয়। ১৯৩৩ সালের ৩০ জানুয়ারি জার্মানিতে ফ্যাসিস্ট হিটলার ক্ষমতা দখল করে। তার বাহিনী ২৭ ফেব্রুয়ারি রাইখস্টাগে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং তার দোষ চাপানো হয় কম্যুনিস্টদের ওপর। কম্যুনিস্টদের ওপর চরম নির্যাতন শুরু করা হয়। প্রকাশ্য রাজপথে বিশ্বের নামকরা কবি-সাহিত্যিক-বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের বইয়ের বহ্নুৎসব করা হয়। সেখানে রবীন্দ্রনাথের বইও ছিল। তারই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৩৩ সালের আগস্ট মাসে ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ বিরোধী লীগ এর কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। ফ্যাসিস্টদের এমনি দানবীয় অভ্যুত্থানে রবীন্দ্রনাথও উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন।

১৯৩৫ সালের ২১ জুন প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল সংস্কৃতি রক্ষায় লেখকদের বিশ্বকংগ্রেস, সেখানে ভারতীয় প্রতিনিধিদের পক্ষ থেকে উপস্থিত চিলেন মুলকরাজ আনন্দ (১৯০৫-২০০০)। সে বছরের শেষের দিকে লন্ডনে ভারতীয় প্রগতি লেখক সংঘ গঠনের প্রক্রিয়া শেষ হয়। ১৯৩৬ সালের ১০ এপ্রিল লক্ষ্ণৌতে অনুষ্ঠিত হয় ভরতীয় প্রগতি লেখক সংঘের প্রথম সম্মেলন। সভাপতিত্ব করেন মুন্সী প্রেমচন্দ (১৮৮০-১৯৩৬)।  সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন কমরেড সাজ্জাদ জহীর। এ সংগঠনের সঙ্গে রীবন্দ্রনাথ সরাসরি সেভাবে যুক্ত না থাকলেও সমর্থন যুগিয়েছেন, শুভেচ্ছা পাঠিয়েছেন। ১৯৩৬ সালের ১৮ জুন ম্যাক্সিম গোর্কি (১৮৫৮-১৯৩৬) মারা যান। ১২ জুলাই নিখিল ভারত প্রগতি লেখক সংঘ কোলকাতার অ্যালবার্ট হলে এক শোকসভার আয়োজন করেন। সে সভায় বঙ্গীয় প্রগতি লেখক সংঘ গঠন করা হয়। ১৬ আগস্ট বঙ্গীয় প্রগতি লেখক  সংঘ গোর্কির স্মরণসভা আয়োজন করেন। সেখানে রবীন্দ্রনাথ গোর্কির স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ইতোমধ্যে মুসোলিনী আবিসিনিয়া আক্রমণ করেছে এবং ১৯৩৬ সালের ১৮ জুলাই জেনারেল ফ্রালেকার নেতৃত্বে স্পেনে ফ্যাসিবাদের দানবীয় অভ্যুদয় ঘটেছে। তারা সে দেশের সরকার ও জনগণের সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। কিন্তু সে দেশের সাধারণতন্ত্রী সরকারের পক্ষে দেশ বিদেশের বুদ্ধিজীবী দল গৃহযুদ্ধে অংশ নেন। ভারত থেকে অংশ নিয়েছিলেন মহারাষ্ট্রের তরুণ গোপাল হুদ্ধার। শহিদ হন র‌্যালফ ফক্স, ক্রিস্টোফার কডওয়েল, জন কর্নফোর্ড, জুলিয়ান বেল, ফ্রেডরিকো গার্সিয়া লোরকা প্রমুখ। ফ্রাঙ্কোর ফ্যাসিবাদী সরকারের বিরুদ্ধে এক ক্ষোভবার্তায় রবীন্দ্রনাথ বলেন:

স্পেনে বিশ্বসভ্যতাকে বিপদগ্রস্ত ও পদদলিত করা হচ্ছে। স্পেনীয় জনগণের গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে ফ্রাঙ্কো বিদ্রোহের পতাকা উড্ডীন করেছে। আন্তর্জাতিক ফ্যাসিবাদ বিদ্রোহীদের সহায়তা করার জন্য  সৈন্য ও অর্থ ঢালছে। ভারাটে সৈনিকেরা ও বিদেশী ফৌজ স্পেনের সুন্দর ভূমির উপর দিয়ে যাচ্ছে- আর পিছনে যাচ্ছে মৃত্যু, নির্জনতা...। স্পেনীয় জনগণের এই চরম পরীক্ষা এবং দুর্দশার মুহূর্তে আমি মানবতার বিবেকের নিকট আবেদন করছি।  স্পেনের জনগণের ফ্রন্টকে সাহায্য করা হোক। স্পেনের জনগণকে সাহায্য করা হোক, লক্ষ লক্ষ কণ্ঠকে সাহায্য করা হোক; স্পেনের জনগণকে সাহায্য করা হোক, লক্ষ লক্ষ কণ্ঠে গর্জে উঠুক প্রতিক্রিয়া। অভিযান বন্ধ কর, গণতন্ত্রের সপক্ষে কোটি কোটি মানুষ এগিয়ে আসুক-এগিয়ে আসুক সভ্যতা ও সাংস্কৃতিক সাফল্যের জন্য।

১৯৩৬ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ব্রাসেলসে যে বিশ্বশান্তি কংগ্রেস অনুষ্টিত হয় সেখানে ‘ভারতীয় প্রগতি লেখক সংঘ’ থেকে একটি ইশতেহার প্রকাশ করা হয়। তাতে স্বাক্ষর করেছিলেন বরীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মুন্সী প্রেমচাঁদ, আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জওহরলাল নেহরু, প্রমথ চৌধুরী, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় এবং শিল্পাচার্য নন্দলাল বসু। রবীন্দ্রনাথ এক বাণীতে বলেছিলেন:

...উন্নত প্রতিক্রিয়া ও জঙ্গীবাদ আজ সভ্যতার ভাগ্য নিয়ে খেলা করছে আর সংস্কৃতি ধ্বংসের উপক্রম করছে। এ সময়ে আমাদের নীরব থাকা হবে অপরাধ। সমাজের প্রতি আমাদের যে কর্তব্য তার ঘোর ব্যত্যয় করা হবে। ...যুদ্ধকে আমরা ঘৃণা করি। যুদ্ধকে আমরা চিরতরে পরিহার করতে চাই, যুদ্ধে আমাদের কোনো স্বার্থ নেই। যুদ্ধ মারফৎ কদর্য ফ্যাসিজম চিরস্থায়ী করতে চায়।

ফ্যাসিবাদ ও যুদ্ধোম্মাদনার পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৩৬ সালের ২৭ অক্টোবর কোলকাতায় কমিউনিস্ট, সোসালিস্ট, ট্রেড ইউনিয়ন ও বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগে ‘ফ্যাসিবাদ ও যুদ্ধবিরোধী লীগ’-এর সাংগঠনিক কমিটি গঠন করা হয়। ২০ নভেম্বর রমাঁ রোলাঁ ফ্যাসিবাদ বিরোধী বর্বরতা প্রতিহত করার জন্য বিশ্ববাসীর কাছে আবেদন জানান। ১৯৩৭ সালের জানুয়ারি মাসে ‘মডার্ন রিভুয়ু’ পত্রিকায় তার অনুবাদ প্রকাশিত হলে সেখানকার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে অভূতপূর্ব সাড়া জাগে। ১১ মার্চ কোলকাতার অ্যালবার্ট হলে স্পেনের গণতান্ত্রিক সরকারকে সাহায্য করার জন্য আবেদন জানিয়ে এক বিরাট জনসভা অনুষ্টিত হয় এবং গঠন করা হয় বঙ্গীয় স্পেন সাহায্য কমিটি। ১২ এপ্রিল বঙ্গীয় স্পেন কমিটির উদ্যোগে কলেজ স্কয়ারে স্পেন সপ্তাহের প্রথম দিকে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সময় রবীন্দ্রনাথ ফ্যাসিস্ট মুসোলিনির একখানা ব্যঙ্গচিত্র অঙ্কন করেন। জার্মানিতে রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। হিটলারের গোয়েন্দা প্রধান গোয়েবলস বলেছিল, ‘আসলে রবীন্দ্রনাথ ইহুদী, তার আসল নাম রাব্বিনাথন’। সে বছর মার্চ মাসেই ‘ফ্যাসিবাদ ও যুদ্ধ বিরোধী লীগ’-এর সর্বভারতীয় শাখা গঠিত হলে তার সভাপতি হন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং সম্পাদক সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর। স্পেনের গৃহুযুদ্ধে রিপাবলিকান দলের সমর্থনে এক বিবৃতিতে রবীন্দ্রনাথ বলেন:

...আন্তর্জাতিক ফ্যাসিবাদের এই বীভৎস জোয়ারকে রুখতেই হবে...। সভ্যতা ও সংস্কৃতির এই সংকটকালে সবাই এসে গণতন্ত্রের পক্ষে যোগ দিন।...

১৯৩৭ সালে প্রগতি লেখক সংঘ প্রকাশ করে দুটি সংকলন--‘টুয়ার্ডস প্রোগ্রেসিভ লিটারেচার’ এবং ‘প্রগতি’। ‘প্রগতি’ উৎসর্গ করা হয়েছিলো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। উৎসর্গ পত্রে লেখা হয়েছিল ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-বরণীয়েষু’। ১৯৩৮ সালে পৌষ মাসে এক ভাষণে নিজ জীবনের লক্ষ্যকে অত্যন্ত আবেগময় ভাষায় তিনি প্রকাশ করে বলেছিলেন:

আমার লেখার মধ্যে বাহুল্য বা বর্জণীয় জিনিস ভুরিভুরি আছে তাতে সন্দেহ নাই। এ সমস্ত আবর্জনা বাদ দিয়ে বাকী যা থাকে আশা করি তার মধ্যে এ ঘোষণাটি স্পষ্ট যে আমি ভালোবেসেছি এই জগৎকে। আমি প্রণাম করেছি মহৎকে। আমি কামনা করেছি মুক্তিকে, যে মুক্তি পরম পুরুষের কাছে আত্মনিবেদনে। আমি বিশ্বাস করেছি মানুষের সত্য মহামানবের মধ্যে যিনি ‘সদা জননাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্ট।’ আমি আবাল্য অভ্যস্ত ঐকান্তিক সাহিত্য সাধনার গণ্ডীকে অতিক্রম করে একদা সেই মহামানবের উদ্দেশ্যে যথাসাধ্য আমার কর্মের অর্ঘ্য  আমার ভাগ্যের নৈবদ্য আহরণ করেছি--তাতে বাইরের থেকে যদি বাধা পেয়ে থাকি, অন্তরের থেকে পেয়েছি প্রসাদ। আমি এসেছি এই ধরণীর মহাতীর্থে এখানে সর্বদেশ সর্বজাতি সর্বকালের ইতিহাসের মহাকেন্দ্রে আছেন মহাদেবতা-তারই বেদীমূলে  নিভৃতে বসে আমার ভেদবুদ্ধির পালন করার দুঃসাধ্য চেষ্টায় আজও প্রবৃত্ত আছে।

১৯৩৮ সালের ২৪ ও ২৫ ডিসেম্বর কোলকাতায় অনুষ্ঠিত হয়েছিলো ভারতীয় প্রগতি লেখক সংঘের দ্বিতীয় সম্মেলন। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন মুলকরাজ আনন্দ (১৯০৫-২০০৪)। সেখানে রবীন্দ্রনাথ প্রেরিত আশীর্বাণী পাঠ করা হয়েছিলো। তারপর ১৯৩৯ সালে ফ্যাসিস্ট হিটলার পোল্যান্ড আক্রমণ করলে শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তারই প্রতিবাদে নাজি-জার্মানির কঠোর সমালোচনা করে রবীন্দ্রনাথ বলেন:

বর্তমান জার্মানির শাসকবর্গের অন্যায়ে ও ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের বহিঃপ্রকাশ বিশ্বের বিবেককে দারুণভাবে আঘাত হেনেছে। এটা ঘটেছে দুর্বলকে ভীতিপ্রদর্শনের দীর্ঘ ঘটনাবলীর পরিণতি হিসেবে-বাইরে ইহুদীদের নিষ্পেষণ থেকে উদারবাদী ও সাহসী চেকোস্লোভাকিয়ার উপর বলাৎকার শুরু করে।

তারও আগে রবীন্দ্রনাথ ফ্যাসিস্টদের যুদ্ধংদেহী মনোভাব আঁচ করতে পেরেই লিখেছিলেন ‘প্রাস্তিক’ কবিতাটি। সেখান থেকে কিছুটা অংশ উদ্ধৃত করা হলো:

নাগিনীরা চারিদিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিঃশ্বাস

শান্তির ললিত বাণী শোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস

বিদায় নেবার আগে তাই

ডাক দিয়ে যাই--

মানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে

মানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে

প্রস্তুত হতেছে ঘরে ঘরে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে রবীন্দ্রনাথ দিন দিন বিষন্ন হয়ে পড়ছিলেন। পাশ্চাত্য সভ্যতার অবদান রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন যেভাবে অধিমূল্যায়ন করেছিলেন বিগত এক দশকের দানবীয় ঘটনা প্রবাহ রবীন্দ্রনাথকে উতলা করে তুলেছিলো। তিনি যেন আর কোথাও আলো দেখতে পাচ্ছিলেন না। তার দেহমন ভাঙ্গতে শুরু করেছে। এমনি অবস্থায় ১৯৪১ সালের ১ বৈশাখ শান্তিনিকেতনে পালিত হয় তাঁর জীবনকালের শেষ জন্মদিন। সেদিন তিনি ‘সভ্যতার সংকট’ নামে প্রবন্ধ পাঠ করে তাঁর সারা জীবনের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের কথা ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করে বলেছিলেন:

জীবনের প্রথম আরম্ভে সমস্ত মন থেকে বিশ্বাস করেছিলুম যুরোপের অন্তরের সম্পদ এই সভ্যতার দানকে। আর আমার বিদায়ের দিনে সে বিশ্বাস একেবারে দেউলিয়া হয়ে গেল। আজ আশা করে আছি পরিত্রাণকর্তার জন্মদিন আসছে আমাদের এই দারিদ্র্য লাঞ্ছিত কুটিরের মধ্যে; অপেক্ষা করে থাকব, সভ্যতার দৈববাণী সে নিয়ে আসবে, মানুষের চরম আশ্বাসের কথা মানুষকে এসে শোনাতে এই পূর্বদিগন্ত থেকেই। আজ পারের দিকে যাত্রা করেছি পিছনের ঘাটে কী দেখে এলুম, কী রেখে এলুম, ইতিহাসের কী অকিঞ্চিৎকর উচ্ছিষ্ট সভ্যতাভিমানের পরিকীর্ণ ধ্বংসস্তূপ। কিন্তু মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ, সে বিশ্বাস শেষ পর্যন্ত রক্ষা করব। আশা করব, মহাপ্রলয়ের পরে বৈরাগ্যের মেঘমুক্ত আকাশে ইতিহাসের একটি নির্মল আত্মপ্রকাশ হয়তো আরম্ভ হবে এই পূর্বাচলের সূর্যোদয়ের দিগন্ত থেকে। আর একদিন অপরাজিত মানুষ নিজের জয়যাত্রার অভিযানে সকল বাধা অতিক্রম করে অগ্রসর হবে তার মহৎ মর্যাদা ফিরে পাবার পথে। মনুষ্যত্বের প্রতিকারহীন পরাভবকে চরম বলে বিশ্বাস করাকে আমি অপমান বলে মনে করি।

রবীন্দ্রনাথের শেষদিনগুলো কাটছিলো বিশ্বযুদ্ধের এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে। অনাক্রমণ চুক্তি থাকা সত্ত্বেও হঠাৎ ২২ জুন হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করে বসল। শান্তিপ্রিয় রবীন্দ্রনাথের দেহমন যেন অসাড় হয়ে পড়ল। এমনিতেই তিনি দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছিলেন। পৃথিবীর আলো বাতাস কোনো কিছুই যেন স্বস্তি দিতে পারছেনা রবীন্দ্রনাথকে। সব সময় তিনি একখানা কালোচাদর দিয়ে নিজেকে ঢেকে রাখতেন। যেদিন শুনছেন হিটলার বাহিনী মার খাচ্ছে সেদিন আগ্রহ নিয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সংবাদ শুনছেন। আর বলছেন, পারবে। ওরাই পারবে মানব জাতিকে রক্ষা করতে। তারপর ১৯৪১ সালের ২২ শ্রাবণ শেষবারের মতো চোখ মুদলেন তিনি। হিটলারের চরম পরিণতি তিনি নিজ চোখে দেখে যেতে পারেননি। তাঁর মৃত্যুর চারবছর পর ঠিক তারই জন্মদিন ৮ মে  ১৯৪৫ ফ্যাসিবাদের কবর রচিত হলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরিসমাপ্তির মধ্য দিয়ে। সেদিন বিজয় সূচীত হয়েছিলো অপরাজেয় মানুষের-যা ছিলো রবীন্দ্রনাথেরও আজীবন বিশ্বাস।

    তথ্যপঞ্জি:

    • নির্বাচিত প্রবন্ধ--হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়
    • ফ্যাসিবাদ অতীত ও বর্তমান--সুকোমল ভট্টাচার্য
    • বিপ্লবী যতীন্দ্রনাথ--শ্রীললিতকুমার চট্টোপাধ্যায়
    • স্বদেশী গান--গীতা চট্টোপাধ্যায়
    • সভ্যতার সংকট--রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
    f
    Elephant Road, Dhaka 1205 +8809606033393 [email protected]
    Free shipping
    for orders over ৳1,999