/  Blogs   /   ভাঁটফুলের দেশে
g

ভাঁটফুলের দেশে

এই ভাঁটফুলের দেশে সাদাকালো জীবনেও নিয়মকরে ফাগুন আসে। সে ফাগুন নতুনের বারতা পৌঁছে দেয় সর্বত্র। আমাদের সাদাকালো-নিরুপদ্রব গাঁয়েও ফাগুনের আগুন আর গোপন থাকে না। সে আগুন ছড়িয়ে পড়ে গ্রামের আনাচে-কানাচে। শিমুল-মান্দারের শাখায় শাখায় সে আগুন দৃশ্যমান হয়। সত্যিকথা বলতে কি, আমাদের গ্রামখানি দেশের অন্যান্য গ্রাম থেকে সামান্যও আলাদা নয়, বরং আরও সাধারণ। গ্রামের পাশ দিয়েই বইয়ে চলা ব্রহ্মপুত্রের শান্ত-শীতল জল গ্রামগুলিকে সাজিয়েছে এক অনন্য সজীবতা-নীরবতায়। যে নীরবতায় পাখির কোলাহল আর একঘেয়ে ঝিঁঝিঁর ডাককেও নৈঃশব্দ বলে মনে হয়। প্রমত্ত ব্রহ্মপুত্র এখন বয়সের ভারে ন্যুজ। তাই তার আগের বিধ্বংসী রূপটি এখন খুব একটা নেই, এখন সে ক্ষয়িষ্ণু। খরা মৌসুমে নদীতে আর তেমন জল থাকে না। তবুও যতটুকু জলের দেখা পেলে একে নদী বলে মনে হয়, ততটুকু জল এখনও ধরে রেখেছে আমাদের গ্রামের পাশেই। তাই ছোট থেকেই পদ্মা-মেঘনা-যমুনা দেখা শিশুমনও একে নদী বলে মেনে নিয়েছে কোনরূপ প্রশ্ন ছাড়াই।

আমাদের গ্রামটি ব্রহ্মপুত্রে জেগে ওঠা একটি চর। ব্রহ্মপুত্র যদি ব্রহ্মের সন্তান হয়, তবে আমাদের গ্রামটিও ব্রহ্মপুত্রের সন্তান। সেই অর্থে আমারা ব্রহ্মপুত্রের বংশধর। গ্রামের মানুষদের সুখ-দুঃখ ওই ব্রহ্মপুত্রই। আমাদের ভালোবাসা যেমন নদীকে ঘিরেই, ঠিক তেমনি সংগ্রামও নদীর সাথেই। বর্ষা এলে গ্রাম ভেসে যায় বানের জলে। আমরা বানভাসি মানুষ। বানের সাথেই আমাদের নিত্য বসবাস। যখন বানের জলে গ্রাম ভেসে যায়, তখন এই সাদাকালো গ্রামকে ছেড়ে পাড়ি জমাতে হয়, নদীর ওপারে উঁচু জায়গায়। বানের পানি নেমে গেলে ফিরে এসে আবারো জীবন-সংগ্রামে নেমে যেতে হয়। নদী ভাঙ্গন তো আর এক ভয়ংকর অভিজ্ঞতা।

এই বসন্তে নদীর জল বেশ শান্ত-সুশীতল। সবুজাভ-স্বচ্ছ জলে পানকৌড়ির সারাদিন ডুব-সাঁতার এখনও নজর কাড়ে। নদী পার হয়েই চরের বালুতে মাখামাখি হয়ে আছে ফসলের সবুজ মাঠ। দূর থেকে গ্রামটিকে বন্য মনে হতে পারে। এই বন্যতা ভেদ করে পাকা সড়ক চলে গেছে শহরে (জামালপুর আর শেরপুর)। বিদ্যুৎ এলেও আধুনিকতা এখনও আসেনি। চরের মানুষের উগ্রতা সম্পর্কে শুনেছি বহু আগেই, কিন্তু এই গাঁয়ের মানুষ বেশ শান্ত প্রকৃতির আর এখনও যথেষ্ঠ সহজ-সরল। শহরের সাথে এত নিবিড় যোগাযোগও তাদের সারল্যকে বিনষ্ট করতে পারনি এতটুকু।

আমাদের গ্রামের নাম রায়েরচর। দক্ষিণে লক্ষীরচর আর উত্তরে বারুয়ামারী। জামালপুর শহরের ১৩ কিমি পূর্বে সদর উপজেলার আওতাধীন এই গ্রামখানি। এর অদূরেই এ অঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যকেন্দ্র নান্দিনা। জামালপুর, ময়মনসিংহ, ঢাকার সাথে নান্দিনার সড়ক ও রেলপথের যোগাযোগ বহু পুরানো, একসময় যোগাযোগ ছিল নৌপথেও। কিন্তু নদী আজ নিশ্চল, নিথর; যার দরুন নৌপথটিও বন্ধ হয়ে গেছে।

একসময় প্রচুর পাট হতো এই গ্রামগুলোতে। রাষ্ট্র কর্তৃক পরিকল্পিতভাবে পাটকে হত্যার পর এখন ধান আর সবজিই প্রধান শস্য। বেগুন, টমেটো, সীম, আলু, কাঁচামরিচ, লাউ, পিয়াজ, রসুন, বাদাম, তরমুজ, বাংগি, আম, কাঁঠাল, নারিকেল প্রভৃতি এখানে উৎপাদন হয়। এই বসন্তে মেহগনি গাছগুলিকে সদ্য মোড়ক খোলা সবুজ গ্রামসজ্জা বলে মনে হয়। আর কত বাহারি গাছে নতুন সবুজ পাতায় খেলা করে লিলুয়া বাতাস। ফসলের মাঠ থেকে ফেরা ক্লান্ত কৃষকের মনে ধরে সে নতুন পাতার বাতাস। হয়ত তখনি তার ভাঙা গলায় শোনা যায় “এ কূল ও কূল ভরা নদী, উথাল পাথাল ঢেউ; বৈঠা হাতে আমি একা, সাথে নাই মোর কেউ...।”

গ্রামের পথে পথে বিপুল অবহেলায় সাদা-সাদা ভাঁটফুল ফুটে আছে আগাছার মতো। তার মন মাতানো ঘ্রাণ হিমেল হাওয়ায় ভেসে যায় বহুদূর। আর সাদা-রাত্রিতে ভাঁটফুলের সাথে জোনাকির খেলা লক্ষ তারার আকাশকে গ্রামে নামিয়ে আনে নিমিষেই। তবুও নিরুত্তাপ হৃদয়ে ভাঁটফুলের প্রতি অবহেলার হয়নাকো অবসান। আমাদের এই ভাঁটফুলের দেশে আপনাকে আমন্ত্রণ।

f
Elephant Road, Dhaka 1205 +8809606033393 [email protected]
Free shipping
for orders over ৳1,999