
সত্য-রূপকথা
মানব সভ্যতার ঊষাকাল থেকে মানুষ জ্যোতির্বিজ্ঞানের নানা বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা শুরু করেছেন।এ ব্যাপারে কখনো একা বা কখনো অপরের সঙ্গে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে তাঁরা প্রাকৃতিক ঘটনাবলি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার প্রয়াস পেয়েছেন।আর বৈজ্ঞানিক রীতিনীতি অবলম্বন করে জ্যোতির্বিজ্ঞানর্চ্চা করা–সে তো সেদিনের কথা।২০০৯ সালে বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞানবর্ষ পালিত হয়েছে।সেখানে জ্যোতির্বিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের নানা আবিষ্কার, উদ্ভাবন ও গবেষণার ফলাফল তুলে ধরা হয়েছে।পাশাপাশি জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের জীবন-কাহিনীও তুলে ধরা হয়েছে।তবে নারী জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের নিয়ে আলোচনা খুব একটা হয়নি।বিশেষ করে বাংলা ভাষায়।অবশ্য এ ব্যাপারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছেন কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসুর (১৮৯৪-১৯৭৪) বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ।জ্যোতির্বিজ্ঞানে নারীদের অবদান তুলে ধরার লক্ষ্যে ২০১০ সালে প্রকাশ করেছেন আকাশছোঁয়া মেয়েরা নামে একটি গ্রন্থ।সেখানে খ্রিস্টপূর্ব ২৩৪৪ অব্দের আগেকার নারীজ্যোতির্বিদ এন হেদুয়ান্না থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যে সকল নারী জ্যোতির্বিজ্ঞানচর্চা করেছেন তাঁদের জীবন ও কর্মের বিবরণ দিয়েছেন।এজন্য বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ ও গ্রন্থটির লেখক জনবিজ্ঞান আন্দোলনের অগ্রসৈনিক অধ্যাপক অরুণাভ মিশ্রকে অভিনন্দন ও ধন্যবাদ।
শুরুতেই বইটি প্রকাশের লক্ষ্য হিসেবে মুখবন্ধ এ বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের কর্মসচিব সুমিত্রা চৌধুরী লিখেছেন, ‘গ্যালিলিওর দূরবীন নিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণের চারশো বছর পূর্তি উপলক্ষে ২০০৯ খ্রিস্টাব্দটি আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান বর্ষ বলে ঘোষিত।এই বছরে বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদের পক্ষ থেকে অরুণাভ মিশ্রর লেখা ‘আকাশছোঁয়া মেয়েরা-মহিলা জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের কথা’ বইটি প্রকাশ করতে পেরে তৃপ্তিবোধ করছি।’ লেখক শ্রীমিশ্র তাঁর নিবেদনে বলেছেন, ‘এই কাজে মহিলা জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের ভূমিকা কিছুমাত্র কম নয়।অথচ তাঁদের কথা প্রচারের আড়ালে রয়েছে চিরকাল।এন হেদুয়ান্না বা অ্যাগাওনিকের কথা আমরা অনেকেই জানি না। হাইপেশিয়ার নাম বিদ্বৎমহলে সামান্য পরিচিত হলে ও সাধারণ মানুষ তাঁর সম্পর্কে জেনেছে কতটুকু?’ গ্রন্থকার সেই কালের এন হেদুয়ান্না থেকে শুরু করে একালের ডেবরা ফিশার পর্যন্ত ২০ জন বিশিষ্ট নারী জ্যোতির্বিদদের জীবন-কর্ম অত্যন্ত সহজ-সরল ভাষায় বর্ণনা করেছেন।তাঁর মতে প্রাচীনকালের জ্যোতিষবিদ্যাই পরবর্তীকালে জ্যোতির্বিজ্ঞান নামে পরিচিতি লাভ করেছে।বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার এবং পরীক্ষানির্ভর ফলাফলের ভিত্তিতে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিকাশ লাভ করেছে।অপরপক্ষে বিশ্বাস নির্ভরতার কারণে জ্যোতিষবিদ্যা স্থবির হয়ে একপাশে পড়ে রয়েছে।কিন্তু প্রাচীনকালে জ্যোতিষচর্চা নামেই চলত জ্যোতির্বিজ্ঞানচর্চা।সেকালের প্রথম নারী জ্যোতির্বিজ্ঞানী এন হেদুয়ান্না ছিলেন চন্দ্রদেবীর মুখ্য জ্যোতিষ আচার্যা।তিনি নিয়মিত ক্ষেত্র পর্যবেক্ষণ করতেন, চন্দ্রকলার হ্রাস-বৃদ্ধি লক্ষ করতেন।তা ছাড়া অন্যান্য জ্যোতিষবিদদের পর্যবেক্ষণকৃত ফলাফল যৌথভাবে বিশ্লেষণ করতেন।সেকালের জ্যোতির্বিজ্ঞিানের বিকাশের ধারায় কাজের পদ্ধতিটি ছিল এই ধরনের।খ্রিস্টপূর্ব ২২ শতকের জ্যোতির্বিদ অ্যাগাওনিকে চন্দ্রকলার পরিবর্তন লক্ষ করতেন।ফলে এক পূর্ণ চাঁদ আবার পূর্ণ চাঁদের পথে কত সময় লাগবে তা তিনি বলে দিতে পারতেন।তিনি চন্দ্রগ্রহণের সঠিক ভবিষ্যৎবাণী করতে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন বলে অনেকে তাঁকে ডাইনী আখ্যায়িত করেছে।আর সেকালের জ্ঞানীদের কাছে তিনি পরিচিত ছিলেন দার্শনিক হিসেবে।
চতুর্থ-পঞ্চম শতাব্দীর রিমে হাইপোশিয়া (৩৭০-৪১৫) ছিলেন একাধারে গণিতবিদ, জ্যোতির্বিদ, দার্শনিক এবং সেকালের আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির কিউরেটর।সেখানকার বিশপ সিরিলের মদদে প্রকাশ্য রাস্তায় তাঁকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।তছনছ করা হয় লাইব্রেরিটিকে।এজন্য বিজ্ঞান বা জ্যোতির্বিজ্ঞানের অগ্রগতি এক হাজার বছর পিছিয়ে পড়েছে বলে মন্তব্য করেছেন বিশিষ্ট জ্যোতি-পদার্থবিজ্ঞানী কার্ল সাগান (১৯৩৪-১৯৯৬)। তারপর ষোড়শ-সপ্তদশ শতাব্দীর নারী জ্যোতির্বিজ্ঞানী সোফিয়া ব্রাহে (১৫৫৬-১৬৪৩) এবং কেরোলিন হার্শেল (১৭৫০-১৮২২) জ্যোতির্বিজ্ঞানচর্চা করেছেন তাঁদের ভাই বিশিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানী টাইকো ব্রাহে এবং উইলিয়াম হার্শেলের সঙ্গে।তা ছাড়া মেরী ফেয়ার ফ্যাক্স সমারভিল (১৭৮০-১৮৭২), মারিয়া মিচেল (১৮১৮-১৮৮৯), অ্যাগনেস মেরী ক্লার্ক (১৮৪২-১৯০৭), উইলিয়া মিনা (১৮৫৭-১৯১১), অ্যানি জাম্প ক্যানন (১৮৬৩-১৯৪১), আন্তোনিও মাউরি (১৮৬৬-১৯৫২), হেনরিয়েটা সোয়ান লেভিট (১৮৬৮-১৯২১), সিসিলিয়া পাইন গ্যাপোস্কিন (১৯০০-১৯৭৯), হেলেন সোয়্যার হগ
(১৯০৫-১৯৯৩),
ডরিট হফলেট (১৯০৭-২০০৭), বারবিজ (জ. ১৯২২) ক্যারেলিন স্যুমেকার (জ. ১৯২৯),
বিয়েট্রিস টিনসলে (১৯৪১-১৯৮১), জসলিন বেল (জ.১৯৪৩), জিল টার্টার (জ.১৯৪৪) এবং ডেবরা ফিসার (জ.১৯৫১)
প্রমুখ খ্যাতিমান নারী জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের জীবন-কর্ম সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে।সেখানে তাঁদের কাজের প্রতি একাগ্রতা ও গবেষণার মান পুরুষদের চেয়ে কিছুমাত্র কম নয়।
নারী জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের এ সকল গবেষণার বিবরণ রূপকথার মতো তুলে ধরেছেন গ্রন্থকার।একটানা পড়তে গিয়ে কোনো ক্লান্তিবোধ হয় না।শেষের দিকে কয়েকজন বিজ্ঞানীর বিবরণে ধারাবাহিকতা কিছুটা ক্ষুণ্ন হয়েছে। কারো কারো জন্ম ও মৃত্যু সালটি উল্লেখ করা হয়নি।বানান বিভ্রাট খুব একটা নেই।বিজ্ঞানীদের একাধিক ছবি সন্নিবেশন করায় গ্রন্থটির আকর্ষণ বেড়েছে। মুদ্রণ খারাপ নয় এবং মূল্যও বেশি নয়।তবে কোনো বাঙালি বা উপমহাদেশের বিজ্ঞানীর অনুপস্থিতি মনকে তৃপ্ত করতে পারেনি।শতবর্ষ আগেও এখানে নারীদের জ্যোতির্বিজ্ঞানে আগ্রহের কথা জানা যায়।স্বর্ণকুমারী দেবী (১৮৫৫-১৯৩২) ‘পৃথিবী’ (১৮৮২) নামক গ্রন্থ লিখে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। ‘This is the best book in popular astronomy and geology in Bengali language.’ তা ছাড়া একালের কল্পনা চাওলা (জ.১৯৬১)
জ্যোতির্বিজ্ঞানের অবদান রেখে চলেছেন।সবশেষে আমরা লেখকের সঙ্গে অভিন্ন মত পোষণ করে বলতে চাই– ‘নানা প্রতিবন্ধবতার মধ্যেও নারী জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের প্রজ্ঞা আর পরিশ্রম, নিষ্ঠা আর ঐকান্তিকতায় তাঁরা জ্যোতির্বিজ্ঞানচর্চা করেছেন এবং অনেক ক্ষেত্রে পুরুষদের সঙ্গে সমানতালে এগিয়ে গিয়েছেন সে কাহিনী রূপকথার মতো সত্যি-সত্যি রূপকথা!’ গ্রন্থটি কিশোরদের উপযোগী করে লেখা হলেও বড়রা আনন্দ পাবেন।আমরা গ্রন্থটির পাঠকপ্রিয়তা ও বহুল প্রচার কামনা করছি।