সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও হিগ্স-বোসন
১৯২১ সাল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বছর।কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের রীডার পদে যোগ দিলেন একজন তরুণ অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু
(১৮৯৪-১৯৭৪)।তিনি গবেষণা কাজ শুরু করেছিলেন তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান ও এক্স-রে ক্রিস্টোলোগ্রাফির ওপর।কিন্তু শ্রেণি কক্ষে পড়াতেন ম্যাক্স প্লাঙ্কের (১৮৫৮-১৯৪৭) কোয়ান্টাম তত্ত্ব। কোয়ান্টাম তত্ত্বের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো বিকীর্ণ শক্তি অবিচ্ছিন্নভাবে বিচ্ছুরিত না হয়ে ঝলকে ঝলকে সূক্ষ্মকণার আকারে বিচ্ছুরিত হয়। এ কণার নামকরণ করা হয়েছিল কোয়ান্টা। ১৯০৫ সালে আলবার্ট আইনস্টাইন (১৮৭৯-১৯৫৫) আবিষ্কৃত আলোকতড়িৎ ক্রিয়া ও অতিবেগুনি বিপর্যয় পড়াতে গিয়ে অধ্যাপক বসু কোয়ান্টাম তত্ত্বের সীমাবদ্ধতার কথা বলছিলেন। তিনি বলছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের চিরায়ত তত্ত্বের সঙ্গে পরীক্ষালব্ধ ফলাফল না মেলার কথা। তবে তিনি একটি ভুল করেছিলেন। যে কারণে তা পরীক্ষালব্ধ ফলের সঙ্গে পুরোপুরি মিলে যায়। তাঁর ভুলটি পরিসংখ্যানের একটি উদাহরণের সাহায্যে বোঝানো যায়।দুটি ধাতব মুদ্রাকে নির্বিচারে প্রয়োগ করা হলে তিনবারের মধ্যে একবার দুই মুখ বা দুই পিঠ বা মুখ-পিঠ (পিঠ-মুখ একই বলে) পড়বে। চিরায়ত নিয়মে এটি ভুল হলেও তিনি ভাবলেন ভিন্নভাবে। কেননা তাঁর পরিসংখ্যান মিলে গিয়েছে পরীক্ষালব্ধ ফলাফলের সঙ্গে। এ বিষয়টি নিয়ে তিনি একটি প্রবন্ধ রচনা করলেন।নাম দিলেন ‘প্লাঙ্কস ল অ্যান্ড দি হাইপথেসিস অব লাইট কোয়ান্টা’। প্রবন্ধটি পাঠিয়ে ছিলেন নামকরা বিজ্ঞান জার্নাল ‘ফিলোজফিক্যাল ম্যাগাজিন’-এ। প্রকাশের অযোগ্য ভেবে কর্তৃপক্ষ তা ফেরত পাঠালেন। কেননা তাঁরা বুঝতে পারেননি আলোককণিকা ফোটনের ক্ষেত্রে সংখ্যাতত্ত্বটি হবে ব্যতিক্রম প্রকৃতির এবং এ নতুন সংখ্যাতত্ত্বটি একই শক্তি অবস্থার মধ্যে একাধিক থাকতে পারবে।
অধ্যাপক বসু নিজের সৃজনশীল চিন্তায় অত্যন্ত বিশ্বাসী ছিলেন।তিনি প্রবন্ধটি আলবার্ট আইনস্টাইনের কাছে মতামত জানার জন্য পাঠালেন।গুণী গুণের কদর বুঝতে পারেন।আইনস্টাইন তা জার্মান ভাষায় অনুবাদ করলেন এবং নিজের মতামতসহ আর একটি প্রবন্ধ রচনা করে দুটো প্রবন্ধই প্রকাশের ব্যবস্থা করলেন ‘জাইট শ্রিফ্ট ফুর ফিজিক’-এ। আলোককণিকার ক্ষেত্রে অধ্যাপক বসুর সেই আবিষ্কারটির নামকরণ হলো ‘বোস-সংখ্যাতত্ত্ব’ নামে। আর বিশেষ পরিস্থিতিতে বস্তুকণিকার ক্ষেত্রে প্রযুক্ত হয়ে তার নতুন নামকরণ হয় ‘বোস-আইনস্টাইন সংখ্যাতত্ত্ব’। আর যেসব কণিকা বোস-আইনস্টাইন সংখ্যাতত্ত্ব মেনে চলে তাদের নাম দেওয়া হলো ‘বোসন’। বোসন নামকরণ করেছিলেন পদার্থবিজ্ঞানের আর এক দিকপাল পি.এ. এম ডিরাক। তারপর থেকে কণা পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে–অনেক নতুন-নতুন কণাও প্রতিকণা আবিষ্কৃত হয়েছে। বিগত ষাটের দশকে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পিটার হিগ্স বস্তুর ভর সংযোজনের জন্যে একশ্রেণির কণার (কাল্পনিক) কথা বলেন যার নামকরণ করা হয় হিগ্স কণা। আর এ পদ্ধতি হিগ্স-এর নামে পরিচিত হয়। এসব কণা বোসন শ্রেণির বলে তার নাম হয় হিগ্স-বোসন। বিগত ৪ জুলাই সার্নের বিজ্ঞানীরা লার্জ হেড্রন কলাইডার-এর পরীক্ষায় তার অস্তিত্ব প্রায় শতভাগ (৯৯.৯৯৯%) নিশ্চিত হয়েছেন।আশা করা যায় অচিরেই তা শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যাবে।কণাটির ভর প্রোটনের ভরের ১৩৩ গুণ। কণাটির আবিষ্কারে পিটার হিগ্স সবিস্ময়ে অনুভূতি ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘আমার জীবনকালে কণাটির আবিষ্কার সম্ভবপর হবে ভাবিনি।’ কিন্তু আশ্চর্য আশির দশকের শেষদিক থেকে বাজারে হিগ্স-বোসনের নাম চালু হয়ে গেছে ‘ঈশ্বর কণা’ নামে।ধান্ধাবাজেরা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও ধান্ধাবাজি শুরু করে দিয়েছে।কণা আবিষ্কারের মধ্যদিয়েও ঈশ্বরের ছোঁয়া স্পর্শ করা! আশ্চর্য, আর আশ্চর্য!
অপরদিকে ১৯২৬ সালে এনরিকো ফার্মি ও পি.এ.এম. ডিরাক নতুন একটি সংখ্যাতত্ত্ব আবিষ্কার করেন।সেটি ‘ফার্মি-ডিরাক সংখ্যাতত্ত্ব’ নামে পরিচিত হয়।বোসন শ্রেণির কণা ছাড়া অপর সব কণা ‘ফার্মি-ডিরাক সংখ্যাতত্ত্ব’ মেনে চলে।এসব কণার নামকরণ করা হয় ‘ফার্মিয়ন’; এনরিকো ফার্মির নামানুসারে।ফার্মিয়ন পাউলির বর্জন নীতি মেনে চলে এবং স্পিন ভগ্নাংশ সংখ্যার।ইলেকট্রন, প্রোটন, নিউট্রন ইত্যাদি ফার্মিয়ন।এগুলো ভরসম্পন্ন কণা।কিন্তু বোসন হলো ভরহীন কণা।যেমন ফোটন, ডব্লিউ-বোসন, জেড-বোসন, গ্লুয়ন এবং গ্রাভিটন।কণা পদার্থবিজ্ঞানের স্ট্যান্ড্যার্ন্ড মডেলে চার প্রকার মৌলিক বলক্ষেত্রের কথা বলা হয়েছে।যেমন তড়িৎ-চৌম্বক বল, দুর্বল নিউক্লিয় বল,
সবল নিউক্লিয় বল এবং মহাকর্ষ বল।তড়িৎ চৌম্বক বলক্ষেত্রের বাহক ফোটন, দুর্বল নিউক্লিয় বলের বাহক ডব্লিউ-বোসন ও জেড-বোসন এবং মহাকর্ষ বলের বাহক গ্রাভিটন।তা ছাড়া বোসন গ্রাভিটনেরও একটি তাত্ত্বিক কল্পনা রয়েছে যা এখনো স্টান্ড্যার্ড মডেলের অন্তর্ভুক্ত নয়।কিন্তু স্টান্ড্যার্ড মডেলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে হিগ্স-বোসন বিবেচিত হয়ে আসছে।তা বাস্তবে উদ্ঘাটিত না করা পর্যন্ত কণা পদার্থবিজ্ঞানীদের ঘুম ছিল না। কেননা তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে বস্তুকণিকার ভর সংযোজনের প্রশ্নটি।মহাবিশ্বের কোন পর্যায়ে সকল কণিকা যেভাবে ভর লাভ করেছে।হিগ্স-বোসনের গুরুত্ব সম্পর্কে সার্নের বিজ্ঞানী টম হুয়াইন টাইয়ের মত হলো–‘হিগ্স-বোসন যদি না থাকত, এই মেকানিজম যদি না থাকত তা হলে মহাবিশ্বে হয়ত আলো ছাড়া আর কিছুই থাকত না। আমরা যাকে ভর বা মাস্ বলি।কোনো বস্তুরই সেই ভর থাকত না।কিন্তু এখন আমরা জানি, বস্তুর ভর কোথা থেকে আসে।যখন কোনো বস্তুর কণা এই হিগ্স-বোসনের সঙ্গে ক্রিয়া করে, তখনই সেই বস্তুর ভর তৈরি হয়।’ এজন্যই জেনেভার সার্ন ল্যাবরেটরিতে সংখ্যাটির জন্য সারা বিশ্বের মানুষ অধীর আগ্রহ নিয়ে দিন ক্ষণের অপেক্ষায় ছিলেন। আর হিগ্স-বোসনের সঙ্গে বাঙালি বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নাম জড়িত থাকার কারণে সচেতন বাঙালিদের মনে বাড়তি চাঞ্চল্য দেখা গিয়েছিল।
সত্যেন্দ্রনাথ বসু জন্মগ্রহণ করেন ১৮৯৪ সালের ১ জানুয়ারি উত্তর কলকাতার গোয়াবাগান অঞ্চলে স্কটিশ চার্চ কলেজিয়েট স্কুলের পাশে ২২ ঈশ্বর মিত্র লেনে। তাঁর পিতার আদি নিবাস ২৪ পরগণার বড়জাগুলিয়া গ্রামে।তাঁর পিতা সুরেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন পূর্বভারতীয় রেলওয়ের হিসাবরক্ষক এবং মা ‘আমোদিনী দেবী ছিলেন আলিপুরের বিখ্যাত ব্যবহারজীবী মতিলাল চৌধুরীর কন্যা।সাত ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়।সত্যেন্দ্রনাথ বসুর শিক্ষাজীবন শুরু হয় নর্মাল স্কুলে।পরে বাড়ির সন্নিকটে নিউ ইন্ডিয়ান স্কুলে ভর্তি হন।তারও পরে এন্ট্রান্স ক্লাসে ভর্তি হন হিন্দু স্কুলে।সেখান থেকে তিনি ১৯০৯ সালে এন্ট্রান্স পরীক্ষায় পঞ্চম স্থান অধিকার করেন।তারপর ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে।এই কলেজে তিনি সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন আচার্য জগদীশচন্দ্র বসু (১৯৫৮-১৯৩৭) এবং আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় (১৮৬১-১৯৪৪)-এর মতো যশস্বী শিক্ষক ও বাঙালি বিজ্ঞানীদের।১৯১১ সালে সেখান থেকে তিনি আই.এস.সি পাস করেন প্রথম স্থান অধিকার করে।সে বছর দ্বিতীয় হন মানিকলাল দে এবং তৃতীয় হন বাঙালি বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা (১৮৯৩-১৯৫৬)।১৯১৩ সালে গণিতে অনার্স নিয়ে বি.এস.সি এবং ১৯১৫ সালে মিশ্রগণিতে এম.এস.সি পাস করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।উভয় পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন।সে বছর তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের নবগঠিত বিজ্ঞান কলেজে মিশ্রগণিতে এবং পদার্থবিজ্ঞানের পঠন-পাঠন ও গবেষণার কাজে নিযুক্ত হন।সে সময় তিনি বন্ধু ড. মেঘনাদ সাহার সাহচর্য লাভ করেন।১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের রীডার পদে যোগ দেন অধ্যাপক বসু।শুরু করেন তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান ও ক্রিস্টোলোগ্রাফির ওপর গবেষণা।১৯২৪ সালে তিনি চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের সাহায্য ছাড়াই কোয়ান্টামতত্ত্বের নীতি প্রতিপাদন করে একটি প্রবন্ধ রচনা করে আলবার্ট আইনস্টাইনের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।প্রবর্তন করেন ‘বোস-সংখ্যাতত্ত্ব’ এবং পরে তার সঙ্গে আইনস্টাইনের নাম যুক্ত হয়ে ‘বোস-আইনস্টাইন সংখ্যাতত্ত্ব’ নামে পরিচিত হয়।১৯২৫ সালে তিনি ইউরোপে যান এবং বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী মাদাম মেরি কুরি,
আলবার্ট আইনস্টাইন, ডি ব্র্যাগলি প্রমুখ বিজ্ঞানীদের সান্নিধ্য লাভ করেন। দু’বছর পর ১৯২৭ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক পদে উন্নীত হন ও পদার্থবিজ্ঞানের বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব লাভ করেন।তিনি ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত ঢাকায় ছিলেন।দেশ বিভাগ আসন্ন হলে তিনি কলকাতা চলে যান।সে বছরেই তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন।
১৯৫৬ সালে তিনি খয়রা অধ্যাপক পদে এবং কয়েক বছর স্নাতকোত্তর বিজ্ঞান বিভাগের ডীন পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।১৯৫৬ সালেই তিনি সেখান থেকে অবসর গ্রহণ করেন।কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে এমেরিটাস অধ্যাপক পদে নিযুক্ত করে এবং ভারত সরকারের আমন্ত্রণে দু’বছরের জন্য বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করেন ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত। ১৯৫৯ সালে তিনি জাতীয় অধ্যাপক পদে নিযুক্ত হন।
আচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু মূলত বিজ্ঞানী হলেও তাঁর ব্যক্তি মানসে সাহিত্যের ধারা,
সঙ্গীতের ধারা এবং বিশেষভাবে মানবিকতার ধারা বর্তমান ছিল।তিনি উপলব্ধি করেছিলেন আধুনিক যুগে দেশের উন্নতির জন্য জনসাধারণের মধ্যে ব্যাপক বিজ্ঞান প্রসার ঘটানো দরকার এবং এ কাজটি মাতৃভাষার মাধ্যমেই সুষ্ঠুভাবে করা সম্ভবপর।ঢাকা অবস্থানকালেই তিনি এ কাজটি শুরু করেছিলেন।চল্লিশের দশকের শুরুতে তিনি ‘বিজ্ঞান পরিচয়’ নামে একটি বিজ্ঞান পত্রিকার প্রকাশের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন।মধ্য চল্লিশের দশকে কলকাতা চলে যাওয়ার পর ১৯৪৮ সালে কলকাতায় তাঁরই উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ’ এবং তাঁর মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হয় মাসিক ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞান’ পত্রিকা।জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তিনি এ প্রতিষ্ঠানের ধারক-বাহক ছিলেন।‘সবুজপত্র’ ও ‘পরিচয়’ সাহিত্যগোষ্ঠীর সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল।তিনি বেহালা ও এস্রাজ ভালো বাজাতে পারতেন।দেশের মুক্তিকামী বিপ্লবীদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল এবং নানাভাবে তিনি তাঁদের সাহায্য ও সহযোগিতা করেছেন। চিরায়ত বাংলা ও বাঙালিদের প্রতি তাঁর দরদ ছিল।তাঁর স্পষ্ট উচ্চারণ ছিল,
‘...যাঁরা বলেন বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চা সম্ভব নয় তাঁরা হয় বাংলা জানেন না বা বিজ্ঞান বোঝেন না।’ ১৯৭৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তিনি কলকাতায় মারা যান।
অধ্যাপক সত্যেন্দ্রনাথ বসু জীবনে বহু সভা-সেমিনারে যোগদান করেছেন এবং নানাভাবে প্রশংসিত ও সম্মানিত হয়েছেন।১৯২৯ সালে তিনি ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসে পদার্থবিদ্যা শাখার সভাপতি এবং ১৯৪৪ সালে মূল সভাপতি নির্বাচিত হন।১৯৩৭ সালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর একমাত্র বিজ্ঞানগ্রন্থটি ‘বিশ্বপরিচয়’ অধ্যাপক বসু’র নামে উৎসর্গ করেন।১৯৫২ সালে কিছুকাল তিনি রাজ্যসভার মনোনীত সদস্য ছিলেন।১৯৫৮ সালে তিনি লন্ডনের রয়াল সোসাইটির ফেলো নির্বাচিত হন।বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘দেশিকোত্তম’ এবং ভারত সরকার ‘পদ্মবিভূষণ’ উপাধি দ্বারা সম্মানিত করেছেন।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে তাঁর নামে প্রবর্তন করা হয়েছে ‘বোস-চেয়ার’।তাঁর স্মৃতিরক্ষার্থে অনেকে কার্জন হলের নাম ‘সত্যেন্দ্রনাথ বসু ভবন’ রাখার প্রস্তাব করেছেন।তা ছাড়া তিনি যে ল্যাবরেটরিতে বসে ‘বোস-আইনস্টাইন সংখ্যাতত্ত্ব’ আবিষ্কার করেছিলেন সেখানে সহজেই তাঁর ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি নিয়ে একটি ক্ষুদ্রাকার মিউজিয়াম গড়ে তোলা যেতে পারে।এসব স্মৃতিচিহ্ন সকলকে অনুপ্রাণিত করবে।
অধ্যাপক বসুর চিন্তাচর্চার মৌলিকত্ব যথার্থভাবে অনুধাবন করেছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন।তিনি বুঝেছিলেন শুধু আলোককণিকা নয় বিশেষ-বিশেষ অবস্থায় বিশেষ বস্তুকণিকাও বোসন হতে পারে।তিনি গাণিতিকভাবে দেখিয়েছিলেন যে হিলিয়াম-৪ পরমাণুকে অত্যন্ত নিম্ন তাপমাত্রায় নিয়ে যাওয়া সম্ভব হলে সেগুলো একেবারে নিম্নতম একই শক্তি অবস্থায় গিয়ে জমা হয় তাকে বলা হয়েছে ‘বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট’। সেটি পদার্থের তিন অবস্থার বাইরেও নতুন একটি অবস্থা অর্থাৎ চতুর্থ অবস্থা।তা নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। ১৯৯৫ সালে এক পরীক্ষায় এটির প্রমাণ পাওয়া গেছে।কোয়ান্টাম সুপার ফ্লুইডতত্ত্বে অতি শীতল হিলিয়াম–৪কে বোস-সংখ্যাতত্ত্বের কারণেই দেখা গেছে চরম ধরনের প্রবহতা লাভ করতে। তা মাধ্যাকর্ষণকে অগ্রাহ্য করে পাত্রের দেয়াল বেয়ে আপনা-আপনি উঠে আসতে পারে। বোস সংখ্যাতত্ত্বের প্রয়োগ ব্যাখ্যা করা সম্ভবপর হয়েছে লেজার আলোর সৃষ্টি, বিদ্যুতের অসীম পরিবাহিতা প্রভৃতি চাঞ্চল্যকর আবিষ্কারে! বোসনের গুরুত্ব ও প্রসঙ্গতা নিয়ে নতুন-নতুন ক্ষেত্র তৈরি হচ্ছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো সত্যেন্দ্রনাথ বসুর নামাঙ্কিত ‘বোসনভা’ সম্প্রতি গবেষণায় দেখা গেছে ‘বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেট’কে বিশেষ ধরনের চৌম্বকক্ষেত্র পরিবর্তনের সম্মুখীন করলে মহাকাশের সুপারনোভা বিস্ফোরণের মতো একটি ক্ষুদ্র বিস্ফোরণ সৃষ্টি হয়। সেখানে কনডেসসেটের অর্ধেক পরিমাণ ভর হারিয়ে যায়। অদ্ভুত ব্যাপার এ ভর কোথায় যায়,
কীভাবে যায় তা এখনো জানা সম্ভব হচ্ছে না। যদিও এ বিস্ফোরণটি অতিকায় ক্ষুদ্র। তবুও এর সঙ্গে সাদৃশ্য রয়েছে মহাকাশের সুপারনোভা বিস্ফোরণের। সে কারণে এরও নাম দেওয়া আছে ‘বোস-সুপারনোভা’ বা সংক্ষেপে ‘বোসনোভা’। বোস-আইনস্টাইন সংখ্যাতত্ত্ব, বোসন, বোস-আইনস্টাইন ঘনীভবন প্রভৃতি বিষয়ে গবেষণা করে অনেকেই সম্মানিত হয়েছেন, পেয়েছেন নোবেল পুরস্কার। ১৯৮৪ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন কার্লো রুবিয়া ও ভ্যান্ডার মীর,
১৯৯৬ সালে ডেভিড এম. সি, ডগলাস, ডি. ওশোরফ ও রবার্ট সি. রিচার্ড, ১৯৯৯ সালে মারটিনাস জে. জি. ভেল্টম্যান ও আই. জেরারজুস্ট হুফ্ট এবং ২০০১ সালে এরিক এলিন কর্নেল, কার্ল এডউইন উয়েম্যান ও জেস ওলফ্যাঙ কেটারলি।তাঁদের নোবেল পুরস্কারের কারণ হিসেবে বোস-আইনস্টাইন ঘনীভবনের উন্নয়নের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
জেনেভার সার্নের বিজ্ঞানীরা হিগ্স-বোসন নিয়ে লার্জ হেড্রন কলাইডার পরীক্ষা অব্যাহত রেখেছেন।যদিও যন্ত্রটির মেরামত, রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নের জন্য নভেম্বর মাসেই পরীক্ষার কাজ বন্ধ রাখার কথা ছিল।তা তিন মাসের জন্য স্থগিত করা হয়েছে যাতে গবেষক দলটি আরো অধিক নতুন তথ্য লাভ করতে পারেন নতুন কণা সম্পর্কে।কেননা মহাবিশ্বের মাত্র ৪ শতাংশ আমাদের জানা।অবশিষ্ট অজানা ৯৬ শতাংশের ৭৩ শতাংশ যা অদৃশ্য বস্তু (ডার্ক ম্যাটার) ও ২৩ শতাংশ অদৃশ্য শক্তি (ডার্ক এনার্জি)।বিজ্ঞানীরা আশা করছেন নতুন কণার আবিষ্কারের মধ্য দিয়েই তাঁর খোঁজ মিলবে। হিগ্স-বোসন আবিষ্কারের ফলাফল ঘোষণাকালে সার্নের মহাপরিচালক রলফ হিউয়ের বলেছিলেন, ‘এটা বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রায় নতুন এক মাইল ফলক, এক নতুন যাত্রার শুরু।’
শুভ হোক এ পথ চলা। বিজ্ঞানের জয় হোক।