প্রসঙ্গ : বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প
সমুদ্রের
অজস্র ঢেউয়ের মত মানুষের পর্যবেক্ষণ, চিন্তা, মনীষা, অনুভূতি, আবেগ, অভিজ্ঞতা সঞ্চরিত হয়ে আসছে বইয়ের মাধ্যমে
সভ্যতার প্রথম প্রহর থেকে। বর্তমান পৃথিবী থেকে বইগুলোকে বিচ্ছিন্ন করলে আমাদের
প্রায় শুরু করতে হবে আদিম ঊষার পূর্বসূরীদের মত। বিশ্বসংস্কৃতিতে বইয়ের অস্তিত্ব
অনেকটা সভ্যতার স্নায়ুতন্ত্রের মত। ওকে বাদ দিলে যা পড়ে থাকে তা নিশ্চল, অসাড় পক্ষাঘাতগ্রস্ত দেহ। সারা বিশ্বে
বই-পত্রের এই গুরুত্ব মাথায় রেখেই রাষ্ট্র বইয়ের বিস্তারে পৃষ্ঠপোষণ করে এসেছে।
কিন্তু বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি ও বিশ্বায়িত অর্থনীতির যুগে বই প্রকাশনা ও বিপণন
পরিণত হয়ে উঠেছে স্বনির্ভর স্বতন্ত্র শিল্পে। বাংলাদেশে ক্ষীণ হলেও সেই প্রক্রিয়া
বিদ্যমান। বাংলাদেশে প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে বাড়তি আরেকটি মাত্রা যুক্ত রয়েছে।
বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের ভিতরে একদিকে প্রেরণা হিসেবে যেমন কাজ করে
ভাষা-সংগ্রাম,
মুক্তিযুদ্ধ
অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার, মুক্তচিন্তায় সমৃদ্ধ বাংলাদেশ নির্মাণের নিরন্তর লড়াই। তারই ধারাবাহিকতায়
কয়েক লক্ষ মানুষের স্বপ্ন,
শ্রম, ঘাম, রক্তের উপর দাঁড়াতে চেষ্টা করছে বাংলাদেশের
বর্তমান প্রকাশনা শিল্প।
১৯৪৭
পাকিস্তানের জন্ম হবার পর পূর্ববঙ্গে শিল্প ও সংস্কৃতির প্রতিকূল পরিবেশেই এই
অঞ্চলের প্রকাশনা শিল্প যাত্রা শুরু করে। নানা প্রতিবন্ধকতা সত্বেও নওরোজ
কিতাবিস্তান,
মাওলা
ব্রাদার্স,
খান
ব্রাদার্স,
পুঁথিঘর
প্রকশনা জগতের ভ্রূণের মত কাজ করেছে। ভাষা আন্দোলন, মুক্তি-সংগ্রামের লড়াই এই অঞ্চলের বোধি ও
চেতনাজগতে নতুন স্ফুরণ ঘটায়। বাংলা সাহিত্যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাজির হন
একদল কবি-লেখক-ভাষ্যকার। এই প্রকাশক ও লেখকদের সম্মিলনে সূচিত হয় স্বাধীনতাপূর্ব
বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প।
স্বাধীনতা
যুদ্ধের সময় চিত্তরঞ্জন সাহা ভারতে আশ্রয় নেওয়া লেখকদের লেখা নিয়ে ৩২টি বই প্রকাশ
করেন ভারতে থেকে। স্বাধীনতার পর সেই বইগুলো নিয়ে বাংলা একাডেমির অনুমতি নিয়ে ১৯৭২
সালের ফেব্রুয়ারিতে চট বিছিয়ে তার উপর শুরু করেন বইমেলার। একাই সেই কাজ ১৯৭৬ সাল
পর্যন্ত করে যান,
তারপর
অন্য প্রকাশকদের সংযোগ ঘটলে একুশের বইমেলা বর্তমান রূপ পায়। একই সময় তিনি গড়ে
তোলেন মুক্তধারা প্রকশনী, যা বাংলাদেশের সৃজনশীল সাহিত্যে মান ও
আঙ্গিকে নতুন মাত্রা যোগ করে। এর সঙ্গে মুক্তধারা লেখক-সাহিত্যিক আবিষ্কারের
গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও পালন করে। চিত্তরঞ্জন সাহা অন্যদিকে গড়ে তোলেন বাংলাদেশ
পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি যা পুস্তক ব্যবসায়ী ও প্রকাশকদের দাবি-দাওয়া
আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। সেই সময়ে বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে সুলভ মূল্যে বই প্রকাশ করে
অনেক দিন পাঠকদের চাহিদা পূরণ করে মুক্তধারা। এর সঙ্গে অন্য নতুন-পুরনো প্রকাশনা
সংস্থাগুলোও ভূমিকা রাখে।
৮০’র
দশকে প্রকাশনা জগতে এক বিরাট পরিবর্তন আসে। হলদে নিউজপ্রিন্টের
বদলে ধবধবে সাদা অফসেট,
লেটার
প্রেসের বদলে অফসেট প্রেস। কালির আঁচড়ের ছিমছাম প্রচ্ছদের জায়গায় রঙবেরঙের বাহারি
সজ্জা। বইয়ের বাহ্যিক কাঠামোর এই পরিবর্তনে যে গতি আসে বইয়ের বিষয়বস্তুর গুণগত
উত্তরণে সেই গতি দেখা যায়নি। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে পুরনো অনেক প্রকাশনা
তাল মেলাতে না পারলেও জন্ম হয় নতুন কিছু প্রকাশনীর, যাদের অনেকেই বর্তমান প্রকাশনা শিল্পে
নেতৃস্থানীয়।
৯০-এর
দশকের শুরুতে বাংলাদেশের প্রকাশনা খাতকে শিল্পের মর্যাদায় উন্নীত করার লক্ষ্য নিয়ে
জাতীয় গ্রন্থনীতি প্রণয়নের প্রস্তাব করা হয়, কিন্তু পরিতাপের বিষয় সেই উদ্যগের
রজতজয়ন্তী পালনের সময় হলেও এখনও পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থনীতি পাওয়া যায়নি।
অন্য
সময়ের চেয়ে বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্প এখন অনেক বৈচিত্র্যময় অবস্থায় পৌঁছেছে।
বাংলাদেশের প্রকাশনা অনেকটাই বইমেলাকেন্দ্রিক। এই শিল্পের বার্ষিক আর্থিক মূল্য
(রেভিন্যু ) ঠিকভাবে জানা সম্ভব নয়, সেই রকম গবেষণা-পরিসংখ্যান নাই বললেই চলে।
তবে বইমেলার একটা হিসেব পাওয়া যায়। বাংলা একাডেমির হিসেব মতে এখনকার প্রতিমেলায় ৫০
কোটি টাকার মত বই বিক্রি হয়ে থাকে। প্রায় ৫,০০০ এর মত বই বছরে প্রাকাশিত হচ্ছে।
যেহেতু প্রকাশনা ও মুদ্রণ যথেষ্ট শ্রমঘন, জ্ঞান ও দক্ষতানির্ভর শিল্প। এর সঙ্গে
যুক্ত আছেন কয়েক হাজার প্রকাশক, ২০,০০০ এর মত বিপণনকারীসহ লক্ষাধিক কর্মী।
পাঠ্যপুস্তক, সৃজনশীল বই, অনুবাদ, মননশীল বই, গবেষণা গ্রন্থ প্রকাশ করে প্রকশনা জগতে
দাঁড়াবার জন্য লক্ষাধিক উদ্যোক্তা, প্রকাশক, কর্মী, বিপণনকারী দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
কিন্তু বর্তমান অবস্থায় এই খাতকে একটি পূর্ণাঙ্গ শিল্পে পরিণত করার জন্য প্রকাশক, নীতিনির্ধারক ও কর্মীদের নতুনভাবে অগ্রসর
হওয়া প্রয়োজন। বর্তমান বিশ্বপরিস্থিতি, আন্তর্জাতিক বাজার বিবেচনায় আমাদের
ভিন্নভাবে ভাবার গত্যন্তর নেই।
বর্তমানে
বিশ্বে প্রকাশনা শিল্পের বার্ষিক আর্থিক মূল্য ১০৬ বিলিয়ন ইউএস ডলার। এর মধ্যে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ২৫ বিলিয়ন ও ইউরোপের অঙ্কটাও এর কাছাকাছি। ইউরোপের অনেক
দেশেই বার্ষিক আয়ে ০.৫ শতাংশ অবদান রাখছে প্রকাশনা শিল্প। সম্প্রতি প্রকাশনা
শিল্পে বিশেষ শক্তিশালী অবস্থান করে নিচ্ছে ব্রাজিল, রাশিয়া, চীন। চীনের ব্যাপক অবস্থার কথা বাদ দিয়ে
আমরা খানিকটা পেছনের ভারতের কথাও যদি ধরি, সেখানে ১৯,০০০ প্রকাশনা সংস্থা ১,০০,০০০ লক্ষের মত বই প্রকাশ করছে বছরে। ৮০টির
বেশি দেশে বই রফতানি করে ভারত প্রায় ৫০০ কোটি ডলার প্রতি বছর আয় করছে। বাংলাদেশ
ভারত থেকে প্রায় ১০ কোটি টাকার বই কিনছে, যার বিপরীতে ভারতে এ দেশের বই রফতানির
মূল্য ১০ লক্ষের কাছাকাছি।
ভারতের
বর্তমান অবস্থার পেছনে একদিকে রয়েছে দায়িত্বশীল ও পেশাদারী মনোভাব সম্পন্ন
উদ্যোক্তা-প্রকাশক,
নিয়ন্ত্রিত
প্রতিযোগিতা আর রাষ্ট্রীয় ও নীতিনির্ধারণী সমর্থন। সেখানে পুস্তক প্রকাশ সংক্রান্ত
উপাদান কাগজ ও অন্যান্য সরঞ্জামাদির ক্ষেত্রে যেমন সাহায্য দেবার চল রয়েছে, তেমনি সরকারিভাবে বই কিনে অভ্যন্তরীণ
বিপণনেও কেন্দ্রীয় ভূমিকা প্রকাশনা শিল্পের সমৃদ্ধিতে সহায়তা করছে।
সারা
বিশ্বে ত্রিশ কোটির অধিক বাংলাভাষী মানুষ রয়েছে। বাংলাদেশেই প্রায় ১৮ কোটি। জনসংখ্যার তুলনায় বর্তমান প্রকাশনা শিল্পের আয়তন কোনভাবেই তুলনীয় নয়। অন্যদিকে
বাংলাদেশের বাইরে ভারতসহ অন্যান্য দেশে অবস্থানরত বাংলাভাষীদের যে বাজার রয়েছে তার
চাহিদা পূরণ করতে গেলে প্রয়োজন স্বাপ্নিক, সাহসী, দায়িত্বশীল, প্রতিযোগী মনোভাবসম্পন্ন প্রকাশক এবং সেই
সঙ্গে রাষ্ট্রীয় ও নীতিনির্ধারক পর্যায়ের সমর্থন।
বাংলাদেশের
প্রকাশনা শিল্পের সামনে একটি বড় অভ্যন্তরীণ বাজার যেমন অপেক্ষা করছে, তেমনি অপেক্ষা
করছে বিশ্ববাজারে প্রবেশ করার সুযোগ। বিশ্বপ্রকাশনা শিল্পে স্থান করে নেওয়া জন্য
নতুনভাবে প্রকাশনা শিল্পকে গড়ে তুলতে হবে। এর জন্য বিদ্যমান সঙ্কটগুলো দূর করে
অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
এক্ষেত্রে
প্রথমে যে সঙ্কট সামনে আসবে তা রাষ্ট্রীয় ও নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের পর্যাপ্ত
পরিচর্যার অভাব। বাংলা একাডেমি, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র ও গ্রন্থাগার অধিদপ্তর মাধ্যমে যে সহায়তা করা হয় তা যে
যথেষ্ট অকিঞ্চিৎকর তা ইতোমধ্যেই প্রমাণিত। জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র ও গ্রন্থাগার
অধিদপ্তরের মাধ্যমে ২ কোটি টাকার মত বই ক্রয় করা হয়ে থাকে, যা বাংলাদেশের জনসংখ্যার সঙ্গে কিছুতেই
সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এই শিল্পের জন্য কাগজ ও অন্যান্য উপাদানের জন্য প্রণোদনা
প্রয়োজন। এর সঙ্গে সাম্প্রতিককালে যুক্ত হয়েছে আরেকটি সঙ্কট। বইয়ের বিষয় বস্তুর
সেন্সর বা বিচার করার নামে যা করা হচ্ছে তা খুবই এলেমেলো (শুদ্ধস্বর, রোদেলা) এবং প্রকাশকদের ভিতরে
কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থার সৃষ্টি করেছে । এই অবস্থা নিরসনে প্রয়োজন পূর্ণাঙ্গ
গ্রন্থনীতি।
প্রকাশনা
শিল্পে আরেকটি সঙ্কট এর বাহ্যিক মান ও বিষয়বস্তুর সার্বিক অবস্থা সন্তোষজনক নয়।
দেশে এখনও পুস্তক সম্পাদনার রীতি তৈরি হয়নি। ফলে পুস্তক যথেষ্ট সুসঙ্গত আকারে
পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে না। এর ফলে এই ক্ষেত্রে পুস্তকের মান উন্নয়নে
প্রতিযোগিতার কোন ধারা সৃষ্টি হয়নি। আরেকটি বাজে পরিস্থিতি যা এখন সবাই জানে তা হচ্ছে
লেখকের টাকায় বই প্রকাশ করার প্রবণতা। এছাড়া প্রকাশনা শিল্পে হিসেব ও অন্যান্য
আর্থিক ব্যাপারে যথেষ্ট নিখুঁত হিসাব যেমন রাখা হয় না, তেমনি এখানে স্বচ্ছতারও ঘাটতি রয়েছে।
দায়িত্বশীল প্রতিযোগী মনোভাবের পরিবেশ তৈরি করা গেলে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটানো
সম্ভব। বইয়ের মূল্য নির্ধারণেও চলছে একরকমের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি।
সৃজনশীল
প্রকাশনার আরেকটি সংকট আমাদের এখানে সাহিত্যের সমালোচনার শক্তিশালী ধারা তৈরি
হয়নি। একারণে লেখকদের নিজদের প্রমাণ করবার সুযোগ যেমন কম, তেমনি তাদের পরিণত হবার সুযোগও কম।
প্রকাশকদেরও লেখক নির্বাচনের সুযোগও সীমিত। একটি সুস্থ সমালোচনার ঐতিহ্য তৈরি হলে
তা সৃজনশীল প্রকাশনা শিল্প দৃঢ় করায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বই নকল ও
পাইরেসির বিরুদ্ধে সঠিক কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে হবে। বর্তমান সময়ে
আন্তর্জাতিকভাবে বই বিপণনে যে পরিবর্তন এসেছে, তার সঙ্গে তাল মেলাতে অনলাইন-ভিত্তিক
বিপণনে নির্ভরশীল মাধ্যম প্রয়োজন। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের ডিজিটাল বইয়ের দিকেও আমাদের
দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
প্রকাশকদের
সংগঠিত একটি প্ল্যাটফর্ম প্রয়োজন যা ন্যূনতম ঐক্যের ভিত্তিতে প্রকাশনা শিল্পের
উন্নয়নে বিভেদের ঊর্ধ্বে কাজ করে যাবে। এতে প্রকাশকদের বক্তব্য যেমন শক্তিশালীভাবে
রাষ্ট্র ও নীতিনির্ধারকদের কাছে পৌঁছবে তেমনি তাদের বিরুদ্ধে যেকোন অন্যায্য আচরণ
রোধ করা যাবে। এরকম আত্মবিশ্বাসী ও দায়িত্বশীল পরিবেশেই প্রকাশনা জগতের পূর্ণ
বিকাশ সম্ভব।
লক্ষাধিক
মানুষ যে শিল্পের সঙ্গে জড়িত তার উন্নয়নে সঙ্কটগুলো দূর করতে প্রয়োজন রাষ্ট্রের
উদ্যোগ,
একটি পূর্ণাঙ্গ
গ্রন্থনীতি। এজন্য একদিকে লেখক, সাহিত্যিক ও সর্বস্তরের পাঠকদের সহায়তা যেমন দরকার, তারও আগে দরকার প্রকাশকদের দায়িত্বশীল
ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া। তাদের সংগঠিত ভূমিকা এবং অনুশীলনই পারে বাংলাদেশের প্রকাশনা
শিল্পকে একটি সম্মানজনক অবস্থানে পৌঁছে দিতে।